Select Page

বুকে বিসর্জনের ব্যথা নিয়েই শেষ করেছি ‘দেয়ালের দেশ’

বুকে বিসর্জনের ব্যথা নিয়েই শেষ করেছি ‘দেয়ালের দেশ’

(হালকা স্পয়লার)
দেয়ালের দেশ; নির্দেশনায়: মিশুক মনি; শ্রেষ্ঠাংশে: শরিফুল রাজ, শবনম বুবলি, আজিজুল হাকিম, এ কে আজাদ সেতু, জিনাত সানু স্বাগতা।

একটা নতুন সিনেমাকে নিয়ে আম-জনতার আগ্রহের শুরু কোথা থেকে?? নিশ্চয় এর টিজার, ট্রেইলার, পোস্টার এসবেই। দেয়ালের দেশ এই প্রতিটা জিনিসেই পাস মার্ক পাওয়ার যোগ্য। এর ট্রেইলার ঈদে মুক্তি পাওয়া অন্য সবক’টা সিনেমার মধ্যে আলাদা একটা সাক্ষরের পরিচয় বহন করেছিল। বুবলির নির্নিমেষ দৃষ্টি আর রাজের ভীত কিন্তু সতর্ক চাহনি ইঙ্গিত দিচ্ছিল জমাটবাঁধা রহস্যের। পর্দায় কতটা জমেছিল সে রহস্য? নাকি সব সময় যত গর্জে তত বর্ষে না? সেই সন্ধানেই দুপুর ২:০৫ এর শোতে ঘুরে বেড়াতে যাই দেয়ালের দেশে।

দুটো অতি ‘সু’ দিক:
এই দুটো অতি সু বা ভালো দিকের সন্ধ্যান পেয়েছি একদম প্রথম ও শেষ দৃশ্যে। প্রথম দৃশ্যে নায়ক ক্যামেরার উলটো দিকে ফেরানো। চারপাশের শব্দে ভেসে আসছে গালাগালির শব্দ। কম্পোজিশন হিসেবে বেশ ভালো। নায়কের মুখ দেখানো হয় নি, নায়কের কোন সংলাপ নেই। কিন্তু আপনি নায়ক কোন সমাজের বাসিন্দা তা জেনে গিয়েছেন। একটা শটে চমৎকার ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট। এবার শেষ দৃশ্যে আসি একটা ড্রোন ক্যামেরায় তোলা ক্লোজ শট থেকে আপ এঙ্গেলে শট। আমরা যে গল্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি তা তুলে ধরার সুন্দর একটা উপায়।

রিগর মর্টিসের কথা:
আমাদের মৃত্যুর পর দেহের মাংসপেশি গুলো নমনীয়তা হারায়। এই নমনীয়তা হারানোর শুরু মৃত্যুর ২ ঘন্টার মধ্যে মুখমন্ডলের পেশি সমূহে। আর এর পরবর্তী প্রায় ২৪ ঘন্টা শরীর জুড়ে এর ক্রিয়া থাকে। এই সময় মৃতের হাত পা আর নড়াচড়া করানো সম্ভব হয় না।

দেয়ালের দেশের আখ্যান:
বৈশাখ পেশায় একজন ডোম। কাজ করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে। এর পাশাপাশি গাঁজা খায়, ক্রিকেট নিয়ে জুয়া খেলে। সেই সাথে প্রেমও করে। তার প্রেমিকা নহর। কাজ করে প্রেম শুকিয়ে জীবনের হিসেব গোলমেলে ঠেকতে থাকা এক দম্পতির বাড়িতে। তারপর মর্গে আসা একটা লাশ চমকে দেয় বৈশাখকে। দুটো সমান্তরাল গল্পে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সময়।

কল্পদৃশ্য ও দৃশ্যকল্প:
দেয়ালের দৃশ্যের টাইটেল কার্ডটা দেখেছেন? নায়ক একটা দেয়ালের সামনে ডান থেকে বামে হেটে যায়; দেয়ালে ফুটে ওঠে টাইটেল; টাইটেলের ঠিক ওপরে দুটো প্রতিকৃতি যাদের অভিমুখ বাম থেকে ডানে। সিনেমাতে পরিচালক আর দর্শকের ভূমিকাটা ঠিক এমনই। পরিচালকের যাত্রাপথ বিমূর্ত থেকে মূর্ত। আর আমরা, দর্শকরা মূর্ত থেকে বিমূর্ত। পরিচালক আর কলাকুশলীরা কল্পনাকে ঠিকঠাক দৃশ্যমান করতে না পারলেই বাধে বিপত্তি। দর্শক আর পরিচালকের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে বিভ্রান্তির দেয়াল।

যেখানে হোঁচট খেয়েছে দেয়ালের দেশ:
দর্শক আর পরিচালকের কল্পনার মেলবন্ধনের সেতুটার পিলার হচ্ছে প্লট, স্প্যান হিসেবে ধরা যায় ক্যামেরাকে, আর নাটবল্টু ধরতে পারেন শব্দকে। ক্যামেরার কাজ দেয়ালের দেশে আপ-টু দ্য মার্ক না। ক্লোজ শট আর বিগ ক্লোজ শটে হাতের কাঁপা-কাঁপি চোখে লেগেছে। প্যানিং গুলো স্মুথ হয় নি। চোখের লাগার মতো কোন এক্ট্রিম লং শট নেই। লং শটগুলোতে পুরো লেন্স ঘোলা হয়ে যাচ্ছিল। বৈশাখের মানসিক বিপর্যস্ত বোঝানোর জন্য একটার বেশি শট রাখার প্রয়োজনীয়তা কেন যে পরিচালক পান নি তা তিনিই ভালো জানেন। ডায়লগে বুবলির কিছু ধারাবাহিকতার অভাব চোখে পড়েছে। আঞ্চলিক আর প্রমিত সংলাপের মিথস্ক্রিয়া ছিল। স্বাগতার প্রতিটা সংলাপ ছিল কেমন যেন অভিব্যক্তিহীন। একটা প্লটহোলের আভাস এই লেখায় দিলাম এমন বেশ কিছু প্লটহোলে সিনেমার গল্প বিপর্যস্ত হয়েছে।

যেখানে সুবাসিত করেছে দেয়ালের দেশ:
প্রথমত অভিনয়। মাত করেছেন বুবলি আর রাজ৷ বিস্তারিত কিছু লিখলে তা স্পয়লার হতে পারে তাই আর লিখলাম না৷ মেকাপ হয়েছে অনবদ্য। রাজকে বেশ কয়েকটা লুকে দেখা গেছে। সব ক’টা বৈশাখ চরিত্রের সাথে যায়। আমাদের সিনেমা নায়িকারা সবসময় মেকাপ নিয়ে গ্ল্যামারাস থাকতে চান চরিত্র যেমনই হোক না। ভালো লাগলো বুবলি তা করেন নি। দুটো গানই শ্রুতিমধুর ছিল। ফলির কাজ ভালো হয়েছে। টিভিতে চলা সিনেমার ডায়লগের সাথে মিলিয়ে রাজের একটা মনোলোগ ধরণের অংশ ছিল। আগে কখনো সিনেমায় এমনটা দেখি নি তাই ভালো লেগেছে। ওহ আর কবরের ভেতর শরীফুলের দৃশ্যটা অসাধারণ। এর আগের দৃশ্যে ছিল বুবলির মৃতদেহের গোসল, পরের দৃশ্যে সদ্য বানানো কবরের পাশে আধ খোঁড়া কবরে শরীফুল। গুড মন্তাজ। কিছু এল কাট ট্রান্সিশনের ব্যবহার দেখেছি।

জেরটানা:
সিনেমা শেষ করেছি আমিও বুকে বিসর্জনের ব্যথা নিয়েই। গল্পটা আরো অনেকদিকে মোড় নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তেমন কোন মোচড় ছাড়াই শেষ হয়ে গেল। দুটো একই জায়গা, একই মানুষ কিন্তু সময়ের দেয়াল পরিচালকের সুযোগ ছিল মন্তাজের সুপ্রয়োগের মাধ্যমে গল্পকে আরো সুন্দর করার। একে আজাদ সেতুকে বড় চরিত্রে দেখছি না, এইটা হতাশাজনক। ক্যামেরা, গতি আর শব্দের মিশেলে মিশুক মনি যে চিত্রভাষায় দেয়ালের দেশের গল্প বলেছেন তা কতটা দর্শকের সাথে পরিচালকের যোগাযোগ ঘটিয়েছে তা সময়ই বলবে। তবে আমার মনে হলো পরিচালক অনেকগুলো ছোট্ট ছোট্ট গল্প বলেছেন, কিন্তু সব গল্প মিলে বিগার ইমেজটা কই যেন হারিয়ে গিয়েছে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মন্তব্য করুন