মাটির দেশের গল্প
মাটির প্রজার দেশে
পরিচালনা : বিজন ইমতিয়াজ
অভিনয়ে : মাহমুদুর রহমান অনিন্দ্য, শিউলি আক্তার, চিন্ময়ী গুপ্ত, রোকেয়া প্রাচী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মনির আহমেদ শাকিল, কচি খন্দকার, আব্দুল্লাহ রানা, ইকবাল হোসেন, রমিজ রাজু।
রেটিং : ৪/ ৫
‘মাটির প্রজার দেশে’ দেখবার আগে কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম এই ভেবে, ২২টির বেশি দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত, প্রশংসিত ছবি, বলিউডের আলীগড়, মাসানকে হারিয়ে দেয়া ছবি আমার ভালো লাগবে তো?
কিছুটা অন্য ধরনের কাজ যারা করতে চান, তাদের অনেকেই পর্দায় নতুন ভাষা শেখাবার চেষ্টা করেন। আমি বুঝি না। কিছু গল্প মাথার ওপর দিয়ে যায়। কিছু চলচ্চিত্র দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, পুরস্কার পাবার লক্ষ্য নিয়ে কিংবা দর্শকদের গাল ভরা বুলি উপহার দেবার জন্যই ওসব চলচ্চিত্রের সৃষ্টি। তবে ‘মাটির প্রজার দেশে’ দেখতে গিয়ে এসব কিছুই মনে হয়নি। সরলতার মোড়কে কী অদ্ভুত সুন্দর সবকিছু! চলচ্চিত্রের নামে পরিচালক বিজন ইমতিয়াজ দর্শকদের নতুন কোনো দর্শন গেলাতে চাননি। দেখাতে চেয়েছেন বাংলার মাটি, মানুষ আর জীবনের গল্প।
এই গল্পে জামাল আছে, লক্ষ্মী আছে, আছে তাদের বন্ধুত্ব। এই গল্পে লক্ষ্মীর মেলায় যেতে না পারা কিংবা জামালের স্কুলে যেতে না পারার দৃশ্য মন খারাপ করে দেয়। লক্ষ্মীকে জড়িয়ে ধরে তার মায়ের কান্না কিংবা জামালকে খুঁজে না পেয়ে তার মায়ের আবেগ মন ছুঁয়ে যায়। সমাজের শেকল ছিঁড়ে লক্ষ্মীর পালকি থেকে নেমে পালাবার চেষ্টা স্তব্ধ করে দেয়। অস্ফুটে বলে ফেলি-‘আহারে!’ বাল্যবিবাহের শিকার ‘লক্ষ্মী’র বিয়ের দিন মায়ের ডিম দিয়ে মেয়েকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া কিংবা ‘মারে, আমি য্যামনে তর হাত ধরলাম, জামাই যদি এইরম হাত ধরে, না করিস না মা। জামাই যদি তোর কাছে আইতে চায়, আইতে দিস। যা যা বলে শুনিস’-এই সংলাপ বুকে এসে লাগে।
লক্ষ্মীর বিয়ের পর জামালের জীবনে সমান্তরালভাবে জন্ম নেয় নতুন এক গল্প। এই গল্প জামালের মায়ের গল্প, রাজ্জাক হুজুরের গল্প, গোঁড়া রক্ষণশীলতার গল্প। রক্ষণশীলতা আর প্রগতিশীলতার দ্বন্দ্ব মানবিকতার স্পর্শে এসে এখানে ঘুচে গেছে। আর দশটা চলচ্চিত্রের মত এ গল্পেও খল চরিত্র আছে। তবে কৃত্রিমতা নেই। সবকিছুই কেমন যেন আমাদের চেনা চরিত্র। অথচ এ গল্প ’৭০ এর, নাকি ’৮০র, নাকি ২০০০ পরবর্তী সময়ের গল্প উল্লেখ নেই। আর এটিই ‘মাটির প্রজার দেশে’ ছবির বড় সাফল্য।
চিরন্তন কিছু সমস্যা আবহমানকাল ধরেই তো বাংলার মাটিতে বিরাজমান। বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়ে দেখা, পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য এগুলো তো বয়ে চলা নদীর মতই চিরন্তন সত্য। তবে ‘মাটির প্রজার দেশে’ হতাশার গল্প নয়। বেঁচে থাকার গল্প। শেষ দৃশ্যের সূর্যোদয় তেমনটিই ইঙ্গিত দেয়। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখায়।
পরিচালক বিজন ইমতিয়াজ তার প্রথম ছবির মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, চেনা পথের বাইরে হাঁটতে গেলেও নির্মোহ থাকা যায়। নির্লোভ থাকা যায়। শুধু পরিচালনা নয়, ৮৮ মিনিটের গল্পে, চিত্রনাট্যে প্রাসঙ্গিক গতি ধরে রেখেছেন তিনি। দেশের বাইরের নামজাদা ফিল্ম স্কুলে পড়লেই সবাই বাংলাদেশের দর্শকদের মন পাবে, এমনটি সবসময় আশা করা যায় না। তবে বিজন ইমতিয়াজ পেরেছেন।
‘মাটির প্রজার দেশে’ দেখবার পর দর্শকদের চোখে মুখে মুগ্ধতাই খেলা করেছে বেশি। আর হবেই না বা কেন? ‘পাপ পুণ্যের বিচার করার আমরা কে? ওপারে শুধু মনের বিচার হবে। শরীরের না’-একজন ধর্মভীরুর মুখ থেকে নিসৃত এমন শুনে বলতে বাধ্য হয়েছি, বিজন ইমতিয়াজ ভীষণ সাহসী।
এ ছবিতে অবশ্য শুধু অভিনয়শিল্পীরাই সংলাপ বলেনি, বলেছে ছবির ক্যামেরাও। ঘোমটার মাঝে চিন্তা ও বাস্তবতার দুনিয়া কত সংকুচিত হয়ে যায় ক্যামেরা দেখিয়েছে। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, নৌকার পাল, নদীর জলতরঙ্গ, গমক্ষেতের সোনালী আলো, সাইকেলের চাকার ঘূর্ণন, টায়ার চালানো-এসব দৃশ্য সশব্দে কথা বলেছে। রাতের নীরবতা বা ঝিঝি ডাকার শব্দ, হাঁসের ডাক, শুকনো পাতার মচমচে শব্দ, পাখির কুহুকুহু কলতান, বাতাসে ধানক্ষেতের শন শন শব্দ কথা বলেছে। শুনেছি, এ ছবির কোনো ডাবিং, রিডাবিং করতে হয়নি। লোকেশন থেকেই শব্দগ্রহণের কাজ করেছেন বলিউডের ট্র্যাপড কিংবা নিউটন চলচ্চিত্রের সাউন্ড ডিজাইনার এন্ড্রু ওয়েসম্যন ও রামশ্রেয়াস রাও। মুগ্ধ হয়ে গেছি গ্রাম বাংলার শাশ্বত রূপ শুনতে পেরে। দেখতে পেরে।
‘মাটির প্রজার দেশে’র নায়ক এর গল্প। নির্দেশনা। আলোক সম্পাত। চিত্রগ্রহণ। শব্দগ্রহণ। পোষাক পরিকল্পনা। রূপসজ্জা। আবহ সংগীত। কিছু ক্ষেত্রে যদিও নিরীক্ষাধর্মী রঙের বিন্যাস ভালো লাগেনি। সংলাপও শতভাগ বাস্তবিক ছিল না। তবে অভিনয়শিল্পীরা এই গুটিকয়েক ঘাটতি পূরণ করে দিয়েছেন।
‘জামাল’ চরিত্রের মাহমুদুর রহমান অনিন্দ্য আমার মন জিতে নিয়েছে। সাইকেলের দোকানে কাজ করা জামাল স্কুলে যেতে চায়। পড়তে চায়। জানতে চায়। অন্যের ব্যাগ নিয়ে যেতে ওর ভালোলাগে না। ও নিজেও স্কুলের ছাত্র হতে চায়। কিন্তু সমাজ সংস্কারের অদ্ভুত গ্যাঁড়াকলে আটকে থাকা জামাল জানেনা ওর সত্যিকারের জন্ম পরিচয়। এমন চরিত্রে অনিন্দ্যকে অভিনেতা মনে হয়নি। মনে হয়েছে সত্যিকারের একজন জামাল। যেমনটি মনে হয়েছে লক্ষ্মী রূপী শিউলী আক্তারকে। তার সংলাপ প্রক্ষেপণ, বডি ল্যংগুয়েজ প্রমাণ করেছে শিউলী নয়, ও ধারণ করেছে লক্ষ্মী’কে। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং রোকেয়া প্রাচী-জাত অভিনয়শিল্পী, সন্দেহ নেই। এ ছবিতে আরো একবার তা প্রমাণ হয়ে গেল। বিশেষ করে রোকেয়া প্রাচীর শুধুমাত্র চোখ ব্যবহার করে অভিনয়ের অদ্ভুত ভঙ্গিমা আমাকে মুগ্ধ করেছে। জামালের মায়ের চরিত্রে চিন্ময়ী গুপ্ত এবং রাজ্জাক হুজুর চরিত্রে মনির আহমেদ শাকিলের অভিনয় আমাকে আবেগ তাড়িত করেছে। ইকবাল হোসেন, রমিজ রাজ, কচি খন্দকার কিংবা আব্দুল্লাহ রানা স্ব স্ব চরিত্রে উজ্জল।
মাটির মানুষ মাটিতেই মিশে যাবে। অথচ মাটির ওপর কতই না বৈষম্যের গল্প। প্রযোজক আরিফুর রহমান এবং পরিচালক বিজন ইমতিয়াজকে ধন্যবাদ, চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের সমাজের কিছু অসুন্দর রূপ তুলে ধরবার জন্য। মনের সঠিক বিকাশ-ই পারবে এসব পঙ্কিলতা থেকে আমাদের মুক্ত করতে। ধন্যবাদ ‘মাটির প্রজার দেশে’ দলকে, নতুন করে আলো জ্বালাবার জন্য।
*রিভিউটি সমকাল ৫ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত।