Select Page

রাঙাভাবী: লোভ এমন আগুন যা শুধু ধ্বংস করে, নির্মাণ করতে পারে না!

রাঙাভাবী: লোভ এমন আগুন যা শুধু ধ্বংস করে, নির্মাণ করতে পারে না!

রবিবার, ১৪ মে ১৯৮৯ ঈদুল ফিতরের অষ্টম দিন রঙ্গম সিনেমায় ‘রাঙাভাবী’ দেখি। মতিন রহমান পরিচালিত শাবানা-আলমগীর ও নূতন এবং বোম্বের টাপু অভিনীত এ ছবির গল্পের মাঝে শিক্ষণীয় বার্তা আছে।

আমি নাটক-সিনেমার মাঝে শুধু বিনোদন খুঁজি না। আমি খুঁজি সমাজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি কী বার্তা দিল।

আমি যখন ‘রাঙাভাবী’ দেখি তখন আমার বয়স চৌদ্দ বছর। চৌদ্দ বছর বয়সটা কিন্তু ফেল না নয়।

স্কুলের মৌলবি স্যার বলতেন, নিজ দায়িত্বে যাবার আগে বয়সের তিনটি পর্ব থাকে। প্রথম সাত বছর স্বাধীনতা। যা ইচ্ছে তাই করো। দ্বিতীয় সাত বছর শুধু শিক্ষা আর শিক্ষা। তৃতীয় সাত বছর হলো শিক্ষার সাথে সাথে নিজে কর, নিজে ভাবো।

চৌদ্দ বছর মানে তৃতীয় সাত বছরের মুখোমুখি হওয়া। নিজে করতাম, নিজে ভাবতাম। ‘রাঙাভাবী’র কাহিনির কিছু বার্তা আমাকে ভাবায়। আমাকে অগ্রিম কিছু শেখায়।

পাকিস্তানের ইকবাল কাশ্মিরির একটি গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আহমেদ জামান চৌধুরী এই ছবির কাহিনি তৈরি করেন।

শাবানা-আলমগীর স্বামী-স্ত্রী। নিঃসন্তান দম্পতি তারা। শাবানার একটি দেবর আছে, বয়সে বালক। আলমগীরের সৎ ভাই। দেবর চরিত্রে অভিনয় করেছে বোম্বের টাপু। আলমগীর সৎভাই টাপুকে পছন্দ করে না।

টাপুর যখন জন্ম হয় তখন বাবা মারা যায়। আলমগীর তখন সৎমা ও সৎভাইকে বাড়ি থেকে বাহির করে দেয়। টাপু যখন বালক বয়সী হয় তখন মা মারা যায়। মা মারা যাওয়ার সময় টাপুকে একজোড়া সোনার বালা দিয়ে বলে, ভাই-ভাবীর কাছে যেতে এবং ভাবীকে বালা জোড়া দিতে।

ভাবী স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে টাপুকে গ্রহণ করে। কিন্তু আলমগীর বিষয়টি সহজভাবে নেয় না। শাবানার কারণে টাপুকে বাড়ি থেকে বাহির করতে পারে না। অথচ টাপু বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির সমান ভাগিদার।

আলমগীর মুস্তাফার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। মুস্তাফার বিশাল সম্পত্তি এবং এলাকার প্রতাপশালী ব্যক্তি। আলমগীরের কাজে তিনি সন্তুষ্ট। তাই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে।

নূতন মুস্তাফার একমাত্র মেয়ে। সদ্য বিদেশ থেকে পড়ালেখা শেষ করে এসেছে। নূতন সুদর্শন আলমগীরের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে নূতন আলমগীরকে কাছে টানতে থাকে। নূতন জানতো আলমগীর বিবাহিত তবুও নিজের সাথে জড়াতে চেষ্টা করে। প্রভাবপ্রতিপত্তির অহংকারে নূতন অন্ধ ছিল।

আলমগীর বিবাহিত এবং স্ত্রী রূপসী, মায়াবতী, প্রেমময় তারপরও আলমগীর নূতনের মোহের মায়াজালে আটকা পড়ে। একসময় তাদের মাঝে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়। যা ছিল উভয়ের স্বইচ্ছায়। উভয়ে ছিল অপরাধী। নূতন জানতো আলমগীর বিবাহিত আর আলমগীরও জানতো সে কে? তার অবস্থান কী!

সাময়িক লোভ আর কামনায় তারা তাদের স্বতন্ত্রতা বিসর্জন দেয়। ব্যক্তিত্ব কালিমাময় করে। মুস্তাফা রাজি ছিল না এই বিয়েতে। যখন জানতে পারে আলমগীর ও নূতন তাদের সম্পর্ক অনেক গভীরে নিয়ে গেছে, তখন রাজি হয়।

আলমগীরের বিবেক জেগে ওঠে। সে বিবাহিত। নূতনকে বিয়ে করলে শাবানা আহত হবে, তা আলমগীর চায়নি। তাই বিয়ে করতে প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু উপরে ওঠার লোভ আলমগীরের বিবেকে থামিয়ে দেয়। নূতনকে বিয়ে করলে রাজকন্যা ও রাজত্ব একসাথে পাবে। শাবানাকে তালাক দিয়ে নূতনকে বিয়ে করে।

নূতন ও মুস্তাফা অর্থ ও প্রতিপত্তি অহংকারে আলমগীরকে ছোট ভাবতে থাকে। যা আলমগীরের জন্য মারাত্মক একটি ধাক্কা। আলমগীর শ্বশুর ও নূতনের দুর্ব্যবহারে মর্মাহত হয়। প্রতিবাদ করলে অপমান করে প্রাসাদ থেকে বের করে দেওয়া হয়।

আগুন নিরপেক্ষ। আগুন দিয়ে যেমন আমরা নির্মাণ করি আবার আগুন দিয়ে আমরা ধ্বংস করি। এতে আগুনের দোষ নাই। আগুন ব্যবহারকারীর দোষ। কিন্তু লোভ এমন একটি আগুন যা শুধু ধ্বংস করে নির্মাণ করে না।

আলমগীর ছিল লোভে অন্ধ। এই লোভের কারণে নিষ্পাপ ছোট ভাইয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে। প্রেমময় স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। স্ত্রী ও ভাইকে ত্যাগ করে প্রিন্সেস নূতনকে বিয়ে করে। কিন্তু আলমগীর কি সুখী হয়েছিল? না। আলমগীর কি রাজকন্যা ও রাজত্বের অধিকারী হতে পেরেছিল? না।

আলমগীর লোভে পড়ে নিজের সোনার সংসারে আগুন লাগায় যে আগুনে আলমগীর দগ্ধ হয়।

অহংকারি নূতন অন্যের স্বামী ছিনিয়ে নিয়ে কি সুখী হয়েছিল? না। অন্যের অশ্রু ঝরিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না।

লোভ মানুষের মনুষ্যত্ব কতটা ধ্বংস করে তা এই ছবির কাহিনির শাখা শাখায় বর্ণিত হয়েছে। লোভের পরিণাম কী জানতে হলে এই ছবির আলম চরিত্রের গভীরে যেতে হবে। যে চরিত্রে আলমগীর অভিনয় করেছে।

গল্পের মূল চরিত্র চারটি। আলমগীর, শাবানা, টাপু ও নূতন। শাবানা ও টাপুর অভিনয়ে দর্শক কেঁদেছে। আলমগীরের ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রে সাবলীল অভিনয়ে দর্শক মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু এইসব চরিত্র আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে। বিশেষ করে আলম চরিত্রে আলমগীর যে শিক্ষা দিয়েছে, তা দর্শকরা কতটুকু শিক্ষাগ্রহণ করেছি?

আমরা তো লোভ লালসার দাসত্ব করি। লোভ আর লালসাকে আমরা ত্যাগ করতে পারি না। সিন্দাবাদের জ্বিনের মতো আমাদের ঘাঁড়ে লোভ লালসা চড়ে বসে আছে।

আর এমন শিক্ষামুলক ছবিই বা আর কত তৈরি হয়েছে?

নির্মাতা ও আমরা কিছু দর্শক ‘ধরো তক্তা মার পেরেক’ টাইপের ছবিতে মাতাল হয়ে থাকি।

সোমবার, ২০ জুলাই ২০২০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

মন্তব্য করুন