শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দিয়েছিলেন বিবৃতি, মামুনুর রশীদকে নাটক করতে মানা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো নিয়ে নাটকপাড়ায় চলছে অস্থিরতা। বিশেষ করে ‘নিত্য পুরাণ’ নাটক নিয়ে বিক্ষোভের পর নতুন করে আলোচনায় এলেন মামুনুর রশীদ। সম্প্রতি তাকে শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে অভিনয় থেকে সাময়িক দূরে থাকার অনুরোধ করেছেন একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ।
এ প্রসঙ্গে মামুনুর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন,‘‘শিল্পকলার ডিজি সাহেব ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন, আমি যাতে শিল্পকলায় অভিনয় না করি। ‘রাঢ়াঙ’ নাটকের ২০০তম প্রদর্শনী হয়েছে। এখন আমাকে বলা হচ্ছে, এই নাটকে যেন অভিনয় না করি। কারণ, হিসেবে তিনি ছাত্র আন্দোলনের সময় দেওয়া ২৪ জন বিশিষ্টজনের একটি বিবৃতির কথা জানিয়েছেন। আমি কিন্তু সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে অভিনয় করেছি, মহিলা সমিতির মঞ্চেও অভিনয় করেছি, তাতেও কোনো সমস্যা হয়নি। শিল্পকলা একাডেমির অসুবিধার জায়গাটা কোথায়? অবশ্যই অসুবিধার একটা জায়গা আছে। কারণ হলো ‘নিত্যপুরাণ’ কে তারা বন্ধ করেছে, পরে এর প্রতিবাদ সভায় আমার ওপর হামলা করেছে। পরদিন আমাদের শো ছিল, কিন্তু তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। তখন থেকেই এই কথাগুলোর সূচনা হলো, আমি যদি অভিনয় করি তাহলে হামলা হবে।’’
শিল্পকলায় মামুনুর রশীদের অভিনয় করা থেকে বিরত থাকা প্রসঙ্গে একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, ‘আমি মামুনুর রশীদকে নিজে ফোন করে তাদের রাঢ়াঙ নাটকের শো করতে বলেছিলাম। এই নাটকটি করা দরকার। এই নাটকে উনি ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। তাকে অনুরোধ করেছি, সেই চরিত্র যদি অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায়। কারণ, আপনি যেহেতু আন্দোলনের সময় রাজাকার নিয়ে কিছু বলেছিলেন, এটা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ, কষ্ট আছে। আপনি গেলে মানুষের সেই কষ্টটা বাড়বে। সেই জন্য আপনি ছাড়া যদি নাটকটির প্রদর্শনী সম্ভব হয়, এটা আপনি দেখেন।’
মঞ্চে অভিনয় না করার এমন অনুরোধে ক্ষোভ জানিয়ে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমি কি অভিনয় করতে পারব না! আমার কোনো অপরাধ নেই, অথচ আমাকে অভিনয় করতে দেবে না। রাজাকার স্লোগান নিয়ে ২৪ জন বিশিষ্টজন বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে আমার নাম ছিল। ওই বিবৃতিতে কী অপরাধ আছে? এখন তো বলা হচ্ছে, আপনারা কথা বলেন। সেই কথাই বলতে পারব না? এমন একটা সময় চলে এসেছে এই বাংলাদেশে, একটি মহল তো চাচ্ছেই শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যাক। আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি, রাঢ়াঙ আমরা করব না, “কম্পানি”ও করব না। চলুক যত দিন এই ব্যবস্থা চলে।’
মামুনুর রশীদকে নিয়ে অভিযোগটি বেশ পুরোনো, যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলের স্লোগান নিয়ে নিন্দা জানিয়েছেন ২৪ নাগরিক।
গত ১৫ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘গতকাল গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল থেকে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ ও ‘আমরা সবাই রাজাকার’ শ্লোগান শুনে আমরা খুবই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বাঙালি জাতিসত্তার লালন, জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার এবং উদার সংস্কৃতি চর্চার তীর্থভূমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকারী রাজাকারদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করে এমন শ্লোগান উচ্চারিত হওয়ায় আমরা যারপরনাই ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি।’
‘আমরা মনে করি, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার আদর্শকে পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে বহন করবার অধিকার কারো নেই। আমরা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানাই এবং আশা করি, তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দাবি আদায়ের পথে পরিচালিত হবে।’
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ১৪ জুলাই রাতে গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে ভারত পলাতক শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ঢাবি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
ওই দিন হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এতো ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা (কোটা) পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’
এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলে আন্দোলনকারীরা, চাইতে গেলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার, তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারও বাপের নয়, কে রাজাকার কে রাজাকার তুই রাজাকার তুই রাজাকার, স্লোগান দেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে আজ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ওই সময় বিষয়টি একপক্ষীয়ভাবে উল্লেখ করে বিবৃতি দেন অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, সৈয়দ হাসান ইমাম, ফেরদৌসী মজুমদার, সুজেয় শ্যাম, ডা. সারওয়ার আলী, আবেদ খান, কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী বীর প্রতীক, মামুনুর রশীদ, মফিদুল হক, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, অধ্যাপক শফি আহমেদ, অধ্যাপক আবদুস সেলিম, অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, ম. হামিদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, গোলাম কুদ্দুছ, শ্যামল দত্ত, অধ্যাপক মলয় ভৌমিক, লাকী ইনাম, সারা যাকের, শিমুল ইউসুফ, আহকাম উল্লাহ ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ।
উল্লেখ্য যে, এক সময় সুন্দরবন রক্ষার পক্ষের নাটক বন্ধে ভূমিকা পালনকারী মামুনুর রশীদ ‘নিত্য পুরাণ’ ইস্যুতে মত প্রকাশ নিয়ে কথা বলে পুরোনো বিতর্ক উসকে দেন।