Select Page

স্মার্ট নির্মাণ ‘শান’

স্মার্ট নির্মাণ ‘শান’

এম রাহিম পরিচালিত এবং সিয়াম আহমেদ, পূজা চেরিতাসকিন রহমান অভিনীত ‘শান’ নির্মাণ শুরু থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে। অনেকেরই ধারণা করেন, ছবিটি আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক, পোড়ামন ২, দেবী-র পর আধুনিক ধারার বাংলা সিনেমার নতুন সংযোজন হতে যাচ্ছে। স্থিরচিত্র বাড়িয়ে দেয় প্রত্যাশা। আর পোস্টার, টিজার, ট্রেলার, গান সেই প্রত্যাশার পারদ বাড়িয়েছে ক্রমশ।

শান দেখার পর প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি কতটুকু হয়েছে?

‘শান’ আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত সম্পূর্ণরূপে অ্যাকশন ছবি। আমি অ্যাকশন ছবি খুব একটা পছন্দ করি না। তবে ‘শান’-এর অ্যাকশন বাস্তবসম্মত এবং নির্মাণের দিক থেকে উন্নত হওয়ায় উপভোগ করেছি। ছবির প্রথমার্ধ কিছুটা ঢিমেতালে চললেও দ্বিতীয়ার্ধ পুরোটাই টান টান উত্তেজনা ও অ্যাকশনে পরিপূর্ণ। অ্যাকশন লাভার না হয়েও আমি ছবির দ্বিতীয়ার্ধে এক মুহূর্তের জন্য বোর হইনি। আমার ধারণা যারা অ্যাকশন দেখতে ভালোবাসেন তাদের জন্য ‘শান’ একটি বিশেষ প্রাপ্তি; কেননা এ ধরনের স্মার্ট অ্যাকশন ছবি বাংলাদেশে খুব কম নির্মিত হয়েছে।

শানের গল্প মানব পাচারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। একটি দুস্কৃতকারী চক্র বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক রফতানির নামে গরীবদের নিয়ে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দেয় এবং গোপন আস্তানায় তাদের বন্দি করে চোখ, কিডনি, লিভার, ফুসফুসসহ নানা অঙ্গ-প্রতঙ্গ নিয়ে বিদেশে বিক্রি করে।

পুলিশ বাহিনী চক্রটির মূল হোতাকে খুঁজতে গিয়ে জানতে পারে ডেভিড নামের একজন এর মূলহোতা। ঘটনাক্রমে এক সময় ডেভিডকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব পরে তরুণ সহকারী পুলিশ কমিশনার শানের ওপর। শুরু হয় অ্যাকশন ও অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর এক পুলিশি অভিযান। যে অভিযানে মানবপাচারকারী দুর্ধর্ষ ডেভিডের মুখোমুখি হয় শান।

ছবিতে শান চরিত্রে অভিনয় করেছেন এ প্রজন্মের ব্যস্ততম নায়ক সিয়াম আহমেদ। নিন্দুকেরা সিয়ামের এক্সপ্রেশন নিয়ে নানা কথা বলে থাকেন। তার উচ্চতা, চেহারার গঠন কিংবা বডি ফিটনেস নিয়েও সমালোচনা করেন। আমি নিজেও অনেকবার এসব বিষয়ে কথা বলেছি। তবে সত্যি কথা বলতে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার পরও সিয়াম যে এ সময়ের বাংলা সিনেমার সবচেয়ে ডেডিকেটেড অভিনেতা তা যে কেউ তার কাজগুলো দেখলে স্বীকার করবে।

অর্থাৎ, সিয়াম তার চরিত্রটি পর্দায় সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। ‘শান’-এ তার ডেডিকেশন যেমন চোখে পড়ে তেমনি চোখে পড়ে ইমপ্রুভমেন্ট।

নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত সিয়ামের সেরা অভিনয় ছিল এ ছবিতে। সে হয়তো মাইন্ডব্লোয়িং অভিনয় দেখাতে পারেনি তবে আগের ছবিগুলো থেকে ইমপ্রুভমেন্ট স্পষ্ট চোখে পড়েছে। তেমন কোন ভুলত্রুটি ছাড়াই বেশ কনভিন্সিং একটা পারফরমেন্স উপহার দিয়েছেন তিনি।

‘শান’ ছিল পুরোপুরি তার কাঁধে এবং তিনি তার দায়িত্ব সর্বোচ্চ ডেডিকেশনের সঙ্গে পূরণ করার চেষ্টা করেছেন।

সিয়ামের আরেকটা বিষয়ের প্রশংসা আমি সব সময় করি; আর সেটা হচ্ছে ছবি সিলেকশন এবং চরিত্র নির্বাচনে রুচি ও বুদ্ধিমত্তা। আরও একবার সিয়াম প্রমাণ করেছেন অন্তত এই বিষয়ে সে এই সময়ের বাংলা সিনেমার সেরা তারকা। শানের মতো একটি চরিত্র যে কোন সুপারস্টারের কাছেও লোভনীয় কিছু। সেখানে সিয়াম এতো অল্প সময়ে সিনেমায় এসে এমন চমৎকার সব চরিত্র নিচ্ছেন বা পাচ্ছেন যা সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো বিষয়।

ছবিতে পূজা চেরি ও তাসকিন রহমান অভিনয় করেছেন অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। সত্যি কথা বলতে সিয়ামের চরিত্রটিতে যতটা যত্ন চোখে পড়েছে এ দুজনের চরিত্রে সেই পরিমাণ যত্ন চোখে পড়েনি। এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে গল্পে টুইস্ট অ্যান্ড টার্ন আসে তাই স্পয়লার হওয়ার ভয়ে ডিটেইলস্‌ আলোচনা করছি না। তবে এইটুকু বলবো যে, সিয়ামের চরিত্রটিকে নির্মাতা যতটা যত্নে সিনেমায় উপস্থাপন করেছেন সেই একই রকম যত্ন ওই দুই চরিত্রও যদি পেতো তাহলে ছবিটি আরও অনেক বেশি উপভোগ্য হতে পারতো।

একটি চরিত্র দৈর্ঘ্যে বড় হতে পারে আবার আরেকটি চরিত্র ছোট হতে পারে। তবে অবশ্যই সব চরিত্রকে সমান যত্নে পর্দায় উপস্থাপন করা উচিত। এই জায়গাটায় নবীন নির্মাতা এম রাহিম কিছুটা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে নবীন হয়েও যেভাবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন এবং যেভাবে ছবিটি যতটা সম্ভব স্মার্ট ও একইসঙ্গে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন তাতে তার প্রশংসা করতেই হবে। বাংলা সিনেমার অনেক পরিপক্ক নির্মাতার চেয়ে কম ভালো ছিল না তার নির্মাণ। ভবিষ্যতে হয়তো তিনি আরও পরিপক্ক হয়ে নিজেকে এ প্রজন্মের সেরা নির্মাতাদের কাতারে নিতে সক্ষম হবেন। প্রথম ছবিতে এইটুকু সম্ভাবনা অন্তত তৈরি করতে পেরেছেন রাহিম।

ছবির গল্প লিখেছেন তরুণ লেখক নাজিম উদ দৌলা। বাংলা বাণিজ্যিক ছবি হিসেবে তার গল্প স্মার্ট। তবে গল্পটি যতটা উপভোগ্য চিত্রনাট্য দাবি করে চিত্রনাট্যকার ততটা উপভোগ্য করতে পারেননি। বিশেষ করে প্রথমার্ধে দুর্বলতা চোখে পড়েছে।

ছবিতে গান আছে তিনটি এবং তিনটিই শুনতে ও দেখতে ভালো লেগেছে। বিশেষ করে লোকেশন, সেট ডিজাইন, কস্টিউম, লাইটিং-এর ব্যবহার বেশ সুন্দর।

কারিগরি দিক যেমন সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং, কালার, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সবই আধুনিক লেগেছে অর্থাৎ সাধারণ বাংলা ছবি থেকে উন্নত। তবে আবার খুব আহামরি কিছুও চোখে পড়েনি তাই এই দিকগুলোর অতি প্রশংসা করছি না। তবে বাংলাদেশের সিনেমা হিসেবে ভালো তো বটেই।

সব মিলিয়ে ‘শান’ ভরপুর অ্যাকশনের বাণিজ্যিক ছবি। যেহেতু ছবির অ্যাকশন ডিরেক্টর বলিউডের অভিজ্ঞ একজন, তাই এ ছবির অ্যাকশন সাধারণ বাংলা ছবি থেকে অনেক বেশি উন্নত। সত্যি কথা বলতে এতটা বাস্তবসম্মত অ্যাকশন ছবি বাংলাদেশে খুব কম নির্মিত হয়েছে। যারা অ্যাকশন ভালোবাসেন তাদের অবশ্যই ভালো লাগবে। সেই সঙ্গে সিয়াম আহমেদকে পর্দায় যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা বেশ নায়কোচিত; যা সিয়ামের ভক্ত এবং বিশেষ করে মাস অডিয়েন্সের বিশেষ ভালো লাগবে।

শানের কিছু দুর্বলতাও আছে। তবে সে সব পরে একদিন না হয় স্পয়লার অ্যালার্টসহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো। আপাতত শক্তিশালী দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। বিগ বাজেটে ও আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত বিশেষ এ ছবি ব্যবসাসফল হওয়া বাংলা ইন্ডাস্ট্রির জন্য বিশেষ জরুরি।

একটি ‘আয়নাবাজি’, একটি ‘ঢাকা অ্যাটাক’ কিংবা একটি ‘পোড়ামন ২’ যেমন আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কিছুটা হলেও একটা পজিটিভ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, ঠিক তেমনই ‘শান’ বক্স অফিসে সফল হলেও আমাদের নতুন ধারার ছবি আরও এক ধাপ সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

তাই একজন সিনেমাপ্রেমী হিসেবে চাই ঈদের ছবি ‘শান’-এর মাধ্যমে শানদার হোক বাংলা ছবির বক্স অফিস। ধন্যবাদ।


About The Author

Leave a reply