‘হাওয়া’র মতো আরও সিনেমা দরকার
‘হাওয়া’ কেমন ছবি সেই বিশেষণ নিয়ে ভাবতে গিয়ে ‘বছরসেরা’, ‘দুর্দান্ত’, ‘অসাধারণ’ শব্দগুলো মাথায় এলেও আমি বেছে নিলাম ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দটা।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা কি মাসালা, ফর্মুলা, প্রেম-প্রেম, অ্যাকশন থ্রিলার বা ফ্যামিলি ড্রামা সিনেমাই দেখবো নাকি এসবের বাইরে গিয়ে ‘স্পেশাল’ কিছু দেখার সময় হয়েছে— এ প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করি। ‘পরাণ’-এর ধুন্ধুমার সাফল্য ‘হাওয়া’র ব্যাপারে আমাকে শঙ্কিত করেছে; কেন না পাশাপাশি মুক্তি পাওয়া একেবারে ভিন্নধারার একটা গল্প আমাদের দর্শক নেবে তো!
মিরপুর সনি স্টার সিনেপ্লেক্সে প্রথম দিনের প্রথম শো দেখতে গিয়ে দর্শকের উচ্ছ্বাস, স্ক্রিনের সামনে ‘সাদা কালা’ গানের সাথে দর্শকের নাচ আর ডায়লগে ডায়লগে হাসির রোল, ক্লাইম্যাক্সে পাওয়া ভয় সবকিছুই আমাকে অবাক করেছে। ‘মিস্ট্রি ড্রামা’র একটা আড়াই ঘণ্টার সিনেমা দর্শক উদ্দীপনা নিয়ে দেখেছে পুরোটা সময়। ‘হাওয়া’ এখানেই লেটার মার্ক পেয়ে গেছে!
সিনেমার প্লট পুরোটা মাঝ সাগরে, নায়ক-নায়িকা বলতে তেমন কিছু নেই, ‘সাদা সাদা কালা কালা’ বাদে গানও নেই, আমজনতার প্রত্যাশামত উরাধুরা ফাইট নেই। এসব বাদ দিয়ে শুধু গল্পটা নিয়ে দেখলে বলতেই হয়, ‘হাওয়া’ বর্তমান ও বিগত দুই দশকের অন্যতম সেরা সিনেমা।
চাঁন মাঝির নেতৃত্বে ‘নয়ন তারা’ নামের মাছ ধরা নৌকা ভাসে সাগরে। এই নৌকায় সিনিয়র-জুনিয়র মিলে নয়জন সদস্য। চাঁন মাঝিকে বাদ দিলে নাগু, এজা, মরা, উরকেস, পারকেস, ইব্রাহিমসহ সবাই যার যার কাজটা নিয়ে সচেতন। তবে মহাজনের বাইরেও চাঁন মাঝি ও এজা মিলে নিজেদের বাড়তি আয়ের জন্য কিছু মাছ অন্যত্র বিক্রি করতে চায়। তবে সাম্যবাদী ইঞ্জিন মেকানিক ইব্রাহিম তাতে বাধা দেয়। ফলে তাকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করে চাঁন মাঝি আর এজা, যোগসাজশ করে ইব্রাহিমের সাথে থাকা নাগুর সাথেও। তবে এই ষড়যন্ত্র সফল হয় না এক রহস্যময়ী নারীর আগমনে।
মাছ ধরতে গিয়ে জালে আটকা পড়ে এই যুবতী, শুরু হয় নতুন উত্তেজনা।
গল্পটি মিস্ট্রি ড্রামার তবে আমাদের একটা পরিচিত মিথোলজি গল্পের যুক্ততা আছে। আপনি সিনেমা শেষ করলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেমন খুশি হবেন আবার অনেক উত্তর না পেয়ে নিজের মতো ভাবতেও পারবেন। গল্পের প্রথম হাফে গাঁথুনী, কমেডি রিলিফ আর প্রত্যেকটা চরিত্র সম্পর্কে কমবেশি ধারণা দেয়া হয়েছে আর দ্বিতীয় হাফে ঘটনার পরিণতি দেখানো হয় খুব গোছানোভাবে।
পারফরম্যান্স বলতে গেলে ‘ভয় পাইছিস’ বলা মুহূর্তে চঞ্চল চৌধুরীকে আমার খুব ভয়ানক চরিত্র মনে হয়েছে। চঞ্চল সত্যিই নিজেকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেলেন। তার কণ্ঠ ‘দেবী’র মিসির আলির মত হলেও চেহারা আর ডায়লগ ডেলিভারি ছিল ইউনিক। সুমন আনোয়ার ‘এজা’ চরিত্রে তার অভিনয়জীবনের সেরা কাজ উপহার দিয়েছেন। কিছু দৃশ্যে তার ঘৃণা প্রকাশ, গালাগালি এতই কানেক্টেড লেগেছে দর্শক তালি দিয়ে উৎসাহ দিয়েছে।
শরিফুল রাজ আর তুষি ‘হাওয়া’ সিনেমার প্রাণ, দর্শকের ভালোবাসার জায়গা! দর্শক এই সিনেমা দেখে রাজের অভিনয় দেখে হয়তো কাঁদবে আবার তুষির অভিনয়ে তালি দেবেই। উরকেস-পারকেস চরিত্রে সোহেল মণ্ডল আর রিজভী রিজু ছিলেন দুর্দান্ত। নামের মত এদের ভালো লাগা আর কাজেও দারুণ মিল। মরা ক্যারেক্টারকে খুব ভাইটাল বিল্ড আপ দেয়া হয়নি। ‘গুলতি’ হিসাবে তুষি তার আগের সব পারফরম্যান্স ছাপিয়ে যাবেই। তার চাহনি আর অভিনয়ে আক্রমণাত্মক দিক প্রশংসনীয় ছিল। নাসিরুদ্দিন খানকে আপনি মাথা থেকে কিছুতেই ফেলতে পারবেন না। নারীসঙ্গকামী এই ‘নাগু’ কমেডি ও সিরিয়াস দুই জায়গাতেই ফাটিয়ে দিয়েছেন।
বিজিএম আর মিউজিক সময়ের সেরা। কামরুল ইসলাম খসরু যেন ক্যামেরায় এক একটা ফ্রেম এনেছেন, এক একটা তুলির আঁচড়ে ছবি এঁকেছেন। নির্মাতা হিসাবে সুমন ক্লাইমেক্সে যে সিগনেচার রেখেছেন, সেটা অনেকের ভালো লাগবে বা লাগবে না, অনেকে হয়তো না বুঝেও অবাক হবে। তবে ‘হাওয়া’র মতো একটা একেবারে আলাদা আঞ্চলিক গল্পের সিনেমা হিট হওয়াটা খুব জরুরি। কেন না, আমাদের সিনেমাপাড়া শক্তভাবে দাঁড়াতে এখন অনেকগুলো ‘হাওয়া’র মতো আন্তজার্তিক মানের ছবি ছবিই দরকার।