হাওয়া: ২৬ বছর পর একা সিনেমা দেখলাম
চঞ্চল চৌধুরীর যে অংশ কখনই ভুলব না, সেটা হচ্ছে ওই যে যখন তুষির হাত থেকে চুন নেয়। চুন নেয়ার সময় তার যে অভিনয়, যা তা রকম সেরা। এটা চঞ্চল চৌধুরীর পক্ষেই সম্ভব …
ছাব্বিশ বছর পর একা সিনেমা দেখলাম। তার আগে টানা এক দশক আমি খালি সিনেমাই দেখেছি। আর প্রতিদিন আব্বার কাছে ধোলাই খেয়েছি। আজ (২৮ আগস্ট ২০২২) ছাব্বিশ বছর পর একা একা সিনেমা হলে। তাও মর্নিং শো। চিরকাল আমি মর্নিং শো দেখেছি। চায়না ফিনিক্স নিয়ে উড়ে গেছি মধুপুর, ঘাটাইল, ভুয়াপুর, আর আমার গোপালপুরের কাকলী মানসী তো ছিলই। কয়েকটা বাদে সবই মর্নিং শো। ফলে আজকের দিনটা আমার জন্য স্পেশাল। একা একা বুঁদ হয়ে দেখলাম ‘হাওয়া’। ‘হাওয়া’ নিয়ে রিভিউ লিখতে বসি নাই। আমার উপলব্ধি লিখছি।
হাওয়া দেখে বেরিয়ে আমার মনে হচ্ছে, এই প্রথম এমন একটা সিনেমা দেখলাম, যা নিয়ে বিস্তারিত না হলেও দেখার জায়গা থেকে একটু বলি।
হাওয়ার কয়েকটা পয়েন্ট উল্লেখযোগ্য।
এক. হাওয়াতে প্রথম চোখে পড়ে সিনেমাটোগ্রাফি। অনিন্দ্য দৃশ্যায়ন। সমুদ্রের এত নান্দনিক দৃশ্য বাংলা চলচ্চিত্রে এর আগে দেখা যায় নাই। ঢেউ যে এত সুন্দর, তা এখানে স্পষ্ট। একটা দৃশ্য চোখে আটকে আছে। যখন প্রথমে ট্রলারে ওঠা মেয়েটাকে সবাই জিজ্ঞেস করে, কীভাবে এই মাঝ দরিয়ায় সে এসেছে, সেই উৎসুক কয়েকজনের ফ্রেমটা বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। কী অসামান্য সেই ছবির কম্পোজিশন। আহা।
দুই. হাওয়া মুগ্ধতায় স্তব্ধ করে দেয় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর সাউন্ড। এত নিখুঁত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এর আগে কখনও শুনি নাই। মেয়েটার নীরবতার সময় মিউজিকটার তুলনা চলে না। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই মিউজিকের ব্যাপারটা ধাক্কা দিয়ে যায়।
তিন. হাওয়াতে মুগ্ধ হতে হয় অভিনেতাদের তুখোড় অভিনয়ে। বিশেষ করে নাসিরুদ্দিন খান এবং সুমন আনোয়ার হাওয়াতে দুর্ধর্ষ। নাসিরুদ্দিনের কোন অংশ বলব? শরিফুল রাজের বিশেষ জায়গায় টোকা দেয়া, সাপলুডু খেলার সময় অদ্ভুত অভিনয়, কিংবা মেয়েটাকে একা পেয়ে যখন মেয়েটার কাছে নিজের বিশেষ জায়গায় আঘাতপ্রাপ্ত হবার সময়, আর বিড়ি মুখে ঝাঁপ দিয়ে জল থেকে ওঠার সময় যে এক্সপ্রেশন, এসব চোখে লেগে থাকবে। সুমন আনোয়ার অনবদ্য। শরিফুল রাজকে খুন করার পরিকল্পনার সময় তার যে লুক, খুন হয়ে যেতে হয় মাইরি। শরিফুল রাজ কিংবা সোহেল মণ্ডলের পাশাপাশি ওই যে রান্না করে যে লোকটা নাম মনে নাই, আরেকজন আছে মাথায় চুল কম, এরাও অসামান্য অভিনয়ে দক্ষতা দেখিয়েছেন। আর নাজিফা তুষির সংলাপহীন অভিনয়ের ভেতরে যতগুলো দৃশ্য সবই মারদাঙ্গা। চঞ্চল চৌধুরীর যে অংশ কখনই ভুলব না, সেটা হচ্ছে ওই যে যখন তুষির হাত থেকে চুন নেয়। চুন নেয়ার সময় তার যে অভিনয়, যা তা রকম সেরা। এটা চঞ্চল চৌধুরীর পক্ষেই সম্ভব।
চার. হাওয়ার গল্প নিয়ে বলি। অনেকেই সিনেমা দেখে এসে লিখেছে গল্পের আগামাথা নাই। আমার মনে হচ্ছে তাদের দুইটা সমস্যা। এক, তারা জীবনে যথেষ্ট পড়ালেখা করে নাই। দুই, তারা এইসব পরাবাস্তববাদ সম্পর্কে সামান্যও জানেন না। এই দুই ভাগের লোকের না জানা নিয়ে কথা বলাটা অনর্থক। নিঃসন্দেহে হাওয়া পরাবাস্তববাদের দুর্দান্ত উদাহরণ।
পাঁচ. হাওয়ার নির্মাণশৈলী নিয়ে না বললে অন্যায় হবে। সিনেমা দেখে বের হবার পর সেই অনুভূতি কাজ করে। ‘আহা, কী দারুণ একটা সিনেমা দেখলাম’। মেজবাউর রহমান সুমন আসলেই এদেশের বিরাট সম্পদ।
আরেকটা দিক নিয়ে বলি। গালিগালাজ নিয়ে অনেকে বলেছেন। কই গালি? কীসের গালি? প্রচলিত কথ্য ভাষা। যারা অভিযোগ তুলেছেন, তারাও হরহামেশা ওসব বলে কিংবা শুনে অভ্যস্ত। এটা নিয়ে অকারণ অভিযোগ তোলার কিছু নাই। আর শালিক পাখির ব্যাপারটা । রান্না করে খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কথা উঠেছে তো। টম হ্যাঙ্কসের কাস্ট অ্যাওয়ে দেখলে তারা অভিযোগটা করতেন না। সার্ভাইভ করার জন্য মানুষ সামনে যা পায়, খায় তাই। হেনরি ডে ভের স্ট্যাকপুল এর লেখা দ্যা ব্লু ল্যাগুন উপন্যাস যাদের পড়া আছে, তারাও জানেন সমুদ্রে আটকে গেলে কত অসহায় হতে হয়। এরকম উদাহরণ অনেক। এক মগের অর্ধেক পানি অবশিষ্ট থাকার পরিস্থিতিতে একটা শালিক ধরে খেয়ে ফেলাটা আসলে কতখানি ক্রাইমের মধ্যে পড়ে, আমি সেই ব্যাখ্যায় যাব না। তবে এটাকে ধরে সিনেমা বন্ধ করে দেবার যে অভিযোগ শুনেছিলাম, সেটা শুনে খারাপ লেগেছে।
যাহোক, হাওয়া মূলত পরাবাস্তববাদের এক অসামান্য গল্প, অসামান্য নির্মাণ। যারা দেখেছেন আবার দেখতে পারেন। যারা দেখেন নাই, তারা দেখে নিতে পারেন। আর যারা বোঝেন নাই, তাদের জন্য সমবেদনা। হাওয়া চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্যালুট।