Select Page

মিস-ফায়ার ও পিঠ-হায়ার বিত্তান্ত

মিস-ফায়ার ও পিঠ-হায়ার বিত্তান্ত

Fire Cinema actress poly hot photoআখতারুজ্জামান আজাদ: ‘ফায়ার’ নামক একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল ২০০৩ সালে, তখন ক্লাস টেনে পড়ি। স্কুলের অনেকের মতো আমিও বারো টাকায় টিকেট কেটে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বরগুনার ‘সোনিয়া’ হলে গেলাম সিনেমাটি দেখতে। পত্রিকা মারফত জেনেছিলাম সিনেমাটিতে নবাগত নায়িকা পলি তার কিছু-একটার পুরোটা দেখিয়েছেন। অবদমিত কৈশোরে ভোগা সমবয়সী অনেকের মতো তখনকার আমি তখনও উন্মুক্ত নারীবক্ষের ছবি দেখিনি। আশৈশব লালিত সেই লালায়িত লোভ পলির ঐ কিছু-একটা দেখে পূরণ হবে ভেবে সিনেমার শুরু থেকেই ছয় ইন্দ্রিয় একযোগে চালু করে বসে রইলাম দাঁতে দাঁত চেপে। গানের দৃশ্য এসে চলে গেল, পলি কথা রাখলেন না; স্নানদৃশ্য এসে চলে গেল, পলি কথা রাখলেন না! এভাবে দর্শক-সম্প্রদায়কে বারবার গাছে তুলে মই কেড়েছেন পলি, দেখাচ্ছি-দেখাচ্ছি করে দেখালেন না কিছুই। শেষের দিকে যখন ধর্ষণদৃশ্য এলো, ভিলেন জাম্বু যখন পলিকে শয্যাশায়ী করলেন; সমবেত জনতার মতো আমিও আশান্বিত হলাম— এবার বুঝি পলির কিছু-একটা দেখা যাবে! তবে, আমাদের আশার গুড়ে বালি ঢেলে আসলাম তালুকদার মান্না উড়ে এসে জুড়ে বসে জাম্বুকে ঠেঙিয়ে বিদেয় করলেন। বারোটা টাকা জলাঞ্জলি দিয়ে হতাহত স্কুলছাত্ররা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেনকে গালাগাল করতে-করতে সে-বারের মতো বাড়ি ফিরল।

বাবুল গোমেজ (জাম্বু)আসলাম তালুকদার মান্না দুজনই পরলোকগমন করেছেন। পলি-সংক্রান্ত সেই ঐতিহাসিক ব্যর্থতার কারণে স্কুলছাত্রদের বর্ষিত অভিশাপে জাম্বু কিংবা জাম্বুকে অপ্রত্যাশিতভাবে বাধা দেবার কারণে ছাত্রদের অভিশাপে মান্না মারা গেছেন কি না, তা না জানলেও এটুকু জানি— পলি এখন চলচ্চিত্রে নিছকই এক পরিত্যক্ত পলিথিন। পলির মতো যারা গায়ে বস্ত্রসস্ত্র রাখতে চাইতেন না, স্থূলস্বাস্থ্যের প্রলয় নাচনে প্রেক্ষাগৃহে ভয়ানক ভূমিকম্প ঘটাতেন; তাদের প্রত্যেকে চলচ্চিত্র থেকে তো হারিয়ে গেছেনই, হারিয়ে গেছেন জীবন থেকেও। প্রযোজকদের রক্ষিতা থাকার মতো রস শুকিয়ে যাবার পর তাদের কেউ এখন রাতের বেলা যাত্রাপালায় নীল নাচ নেচে জীবিকা নির্বাহ করছেন, কেউ বা নিভৃতে মাংসবিক্রির পেশা বেছে নিয়েছেন নিষিদ্ধ নিকেতনে!

রুপোলি পর্দায় আমাদের কৈশোর মাতিয়েছিলেন শাবনুর-মৌসুমিরা। নব্বইয়ের দশকের এই দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেত্রী পর্দায় অপ্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রদর্শন করেননি। ঐ জামানায় যারাই এসেছেন, সংক্ষেপে জনপ্রিয় হতে তাদের অনেকেই পর্দায় বেপর্দা হয়ে ভাঁজ খুলেছেন এবং যিনিই একবার ভাঁজ খুলেছেন, তিনিই আর সেই ভাঁজ থেকে বেরোতে পারেননি, অতল তলে তলিয়ে গিয়ে পরিণত হয়েছেন পরিত্যক্ত তলানিতে। শাবনুর আপাতত পর্দার বাইরে থাকলেও মৌসুমি আজও পর্দা কাঁপিয়ে চলছেন; তিনি এখনও কাঁপন তুলছেন এমন-সব তরুণের মনে, যাদের বয়সের চেয়ে মৌসুমির অভিনয়জীবনের বয়স বেশি! জাহিদ হোসেন পরিচালিত ‘মাতৃত্ব’ ছবিতে বাচ্চাকে দুগ্ধপান করাবার একটি দৃশ্য ছিল মৌসুমির। খুবই স্বাভাবিক, সহজাত ও অপরিহার্য একটি দৃশ্য ছিল সেটি। উত্তরসূরিদের মতো গা খুলে গা ভাসালে মৌসুমি আজ মৌসুমি হতে পারতেন না।

বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বরেণ্য অভিনেত্রী নিঃসন্দেহে সুচিত্রা সেন, ববিতা, শর্মিলা ঠাকুর, কবরী, শাবানা প্রমুখ। সুচিত্রার ব্যক্তিত্বময় চাহনী, ববিতার বালখিল্য দুষ্টুমি, কবরীর কলজে-ভেদী ক্রন্দন ইত্যাদি নিয়ে যুগ-যুগ গবেষণা হবে; মৃত্যুর শতাব্দীকাল পরেও তারা প্রাসঙ্গিক হবেন। এই অভিনেত্রীরা যেমন পুরুষপ্রজাতির পূর্বপ্রজন্মের স্বপ্নকন্যা ছিলেন, তেমনি স্বপ্নকন্যা হয়ে আছেন উত্তরপ্রজন্মেরও। এদের কেউ যদি একটিবারের জন্যও পর্দায় বেপর্দা হতেন, দর্শক তৎক্ষণাৎ তাকে ছুড়ে ফেলে দিত।

রাইমা সেন নাম্নী এক নায়িকা আছেন টালিগঞ্জে। অভিনয় মন্দ না করলেও ভদ্রমহিলা নিজ পরিচয়ে কখনও পরিচিত হতে পারেননি, ‘সুচিত্রা সেনের নাতনি’ পরিচয়ই আজও তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বোধহয় এমন কোনো সিনেমা নেই, যেটিতে ইনি রগরগে শয়নদৃশ্যে নেই; শয়নাংশটুকু বাদ দিতে পারলে ইনি নিজ পরিচয়েই পরিচিত হতে পারতেন।

গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রে পাওলি দামকে দেখে বিস্ময়াভিভূত ছিলাম দীর্ঘদিন। অনন্য অভিনয় আর দোর্দণ্ড দেহবল্লরীর অধিকারী এই অভিনেত্রী যাবজ্জীবন আমার ঘুম না হবার কারণ হতে পারতেন, যদি তিনি ‘ছত্রাক’ ছবিতে আপাদমস্তক দিগম্বর না হতেন। ছত্রাকে পাওলিকে যেভাবে দেখেছি, তাতে তাকে আর কোনো দিন দেখার রুচি জাগবে না। এক বার নগ্ন হয়ে আমার মুগ্ধতাটুকুকে গলা টিপে হত্যা করলেন পাওলি দাম!

sporshia-nudeঅর্চিতা স্পর্শিয়া নামক সদ্য টিনএজ-পেরুনো এক নাট্যশ্রমিকের নাম শুনেছি কয়েকবার। তার অভিনীত কোনো নাটক আমি না দেখলেও অভিজাত ঘরের ছেলেপুলেদের পছন্দের তালিকায়ই তার নাম আছে বলে জানতাম। উদ্ধত রিপুর তাড়নায়ই হোক, সংক্ষেপে পাদপ্রদীপের আলোয় আসতেই হোক, হোক বিবদমান কোনো সহকর্মীকে টেক্কা দিতে; এই অর্বাচীন তরুণী গতকাল তার পেজে বিবস্ত্র পিঠের একটি ছবি আপলোড করেছেন। কেবল পৃষ্ঠদেশ বা পশ্চাৎদেশ কেন, সাড়ে তিনহাত বাংলাদেশকে অনাবৃত করলেও কারো অধিকার নেই স্পর্শিয়াকে তিরস্কার করার; বিবসনা হয়ে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারে পড়ে থাকলেও কারো অধিকার নেই স্পর্শিয়ার ওপর হামলে পড়ার। তবে ছোট মুখে যে বড় কথাটুকু বলে যাওয়া দরকার, তা হলো— মোড়ক উন্মোচনে কৃতিত্ব নেই, কৃতিত্ব নেই খুলখাল্লাম খামখেয়ালিতে। এমনতর ছবি কতিপয় কিশোরের স্বখেচনের খোরাক ছাড়া আর কিছুই যোগাবে না। যে মডেল আজ খোলা দেহের আদ্ধেকটা দেখালেন, কাল দর্শক তার খোলা দেহের পুরোটা দেখতে চাইবেন; ভবিষ্যতে তার ঢাকা দেহ দেখে দর্শক সেরেফ বিরক্ত হবে।

সম্প্রতি সাইয়েদ জামিল নামক এক নগ্ন পদ্যকারের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। প্রথম আলোর প্রশ্রয়ে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিলেন, তাকে ‘জীবনানন্দ দাশ পদক’ দেয়ার পর জনতা প্রথম আলোকে ধুয়ে দিয়েছিল, বাধ্য হয়ে প্রথম আলো সেই পদক প্রত্যাহার করে দেয়; শেষতক জামিলের ঠাঁই হয়েছে নগ্নতার নিষিদ্ধ গূহ্যদ্বারে। অহেতুক নগ্নতার ঠাঁই শিল্পজগতের কোথাও হয়নি— তা কবিতাই হোক, আর অভিনয়ই হোক।

নগ্ন হয়ে ফেসবুক-ইশুতে পরিণত হবার ইচ্ছে যাদের, তাদের জেনে রাখা ভালো— ফেসবুকে নগ্নতা-লব্ধ চাঞ্চল্যের মেয়াদ মোটে দুই দিন। নতুন হিশুতে পুরোনো ইশু ভেসে বরবাদ হতে ফেসবুকে দু-দিনের বেশি লাগে না!

(লেখাটি কবি আখতারুজ্জামান আজাদের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত। বিএমডিবি-তে তার ব্যক্তিগত কোন একাউন্ট না থাকায় বিএমডিবি-র পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে।)


মন্তব্য করুন