শ্রাবণ জলে ভিজিয়ে দিলো পদ্ম পাতার জল …
বিশ্বাস বলে যেখানে কিছু নেই সেখানে সুযোগ দেবার কি মানে? এমন কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে যবনিকা টানলেন পরিচালক তন্ময় তানসেন।
বলছিলাম মনমুগ্ধকর পদ্ম পাতার জল ছবির সমাপ্তির কথা। সব ছবির বেলায় আমি শুরু থেকে বর্ননা করি, এবার করছি শেষ থেকে। কারন এক ফোটা জল পদ্ম পাতায় কতোটা নড়বড়ে তা বাস্তব জীবনে বহুবার আমরা দেখেছি, কিন্তু সেলুলয়েডের পর্দায় এমন চমৎকার উপস্থাপন সচরাচর দেখা যায় না।
ফুলেশ্বরী (বিদ্যা সিনহা মীম),যার জন্মই হয়েছে এক ভয়ঙ্কর দানবের ঘরে তার ভাগ্যে বিধাতা রাজপুত্র ঠিকই দিয়েছিলেন কিন্তু সেই তলাবিহীন রাজপুত্রের ছিল না কোন সাহস, নিজের উপর ছিলনা আত্মবিশ্বাস। ফুলেশ্বরীর ভালোবাসার সন্মান সে দিতে পারেনি। কাহিনীর শেষ পর্যায়ে ফুলেশ্বরী নিজেই ব্যক্ত করেছে-আমার মুক্তি আমি নিজেকেই করেছি। কিন্তু সেই সত্য জানতে অনেক দে্রী হয়ে গেছে জমিদার পুত্রর। প্রেমের কাহিনী নিয়ে করা পূর্নদৈর্ঘ্য ছবিতে নায়ককে দেখা যায় প্রেমে অন্ধ হয়ে মাতাল বনে গিয়ে পথে পথে হাঁটতে, কিন্তু এই ছবির টার্নিক ছিল খুব আচমকা এবং অপ্রত্যাশিত।অবিরত চুরুট টানতে থাকা সরফরাজ আচমকা উপস্থিত হয়ে পুরো গল্পের মোড় বোদলে দিলেন। যে ফুলেশ্বরীর জন্য জমিদার পুত্র রিজোয়ান (ইমন) দিন রাত এক করে দিয়েছে সেই কিনা বিনা বাক্য ব্যয়ে বিক্রী করে দিল তার প্রিয়তমাকে। স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও সরফরাজ চরিত্র বিশাল একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে রয়ে গেছে পুরো ছবিতে।আর কবি চরিত্র অসাধারন ফুটিয়ে তুলেছে ইমন।
মীরাক্কেল চ্যাম্পিয়ন রনির প্রতিভা আমাদের কারো অজানা নয়, তারপরও যতবার তাকে স্ক্রীনে দেখলাম মনে হয়েছে ওর ভেতর যা আছে তা পুরোটা পরিচালকরা ঠিকঠাক বের করে আনতে পারছেন না, যদিও এই ছবিতে ভাঁড়ামী করতে তাকে দেখা যায় নি। একই রুমে তিন বন্ধু কেমন মজার সময় কাটাতে পারে তার কিছু চিত্র উঠে এসেছে। বন্ধু চরিত্রে দুইজনই ছিল খুবই সাবলীল ।
এই ছবির সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় গানের লোকেশন এবং সংলাপ। সংলাপগুলো খুব মার্জিত এবং সময় বুঝেই প্রয়োগ করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলের কাহিনী নিয়ে হলেও গানের চিত্রায়নে চমৎকার আধুনিকতার ছাপ। আর কবির মুখে দু’চার লাইনের ছন্দের খেলা দর্শককে বেশ আনন্দ দিয়েছে তা পিন পতন নীরবতাই বলে দিচ্ছিল। ইউরোপ আমেরিকা না ঘুরে নিজের দেশেই যে এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্যায়ন করা যায় তা প্রমাণ করলেন পরিচালক। গানের সব দৃশ্য মনে রাখার মতন হলেও গানের কথা খুব একটা মন ছুঁয়ে যায় নি যেটা আমি প্রমো দেখে আশা করেছিলাম। বলাকা হলের সাউন্ড সিস্টেমের জন্যে কিনা জানিনা, বেশির ভাগ শব্দই কানে এসে দমকা হাওয়ার মতোন ধাক্কা দিচ্ছিল। বিশেষ করে তুষার যখন গজলের সুর ধরলো তখন হঠাৎ নিপূনের আগমন উদ্ভট লেগেছে। এই চরিত্রের আদৌ কি কোন প্রয়োজন ছিল? পুরো গানের দৃশ্য মাঠে মারা গেছে।
ব্যান্ডের ভোকালিস্ট কিভাবে এমন দার্শনিক ছবি বানালেন তাই নিয়ে আমি ভাবছি। আসলে চলচ্চিত্র বানানোর জন্যে কেবল পড়াশোনা প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় মেধার। পরিচালক তন্ময় তার পুরোটাই কাজে লাগিয়েছেন। গতানুগতিক রোমান্টিক ছবির বাইরেও যে রোমান্স তুলে ধরা যায় তা তিনি সফল ভাবেই দেখাতে পেরেছেন দর্শককে। পরিশেষে ড্রেস ডিজাইনার এবং মেকাপ আর্টিস্টকে আমার তরফ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ, কারন মীম এমনিতেই ফর্সা। ওকে রংমহলের বাইজীর চরিত্রায়ন করতে হয়েছে বলে বাংলা ছবির তথাকথিত মেকাপ দিয়ে মুখ খানা ভরে দেননি বলে। “আমার আছে জল“ থেকে যাত্রা শুরু মীমের চলচ্চিত্র জগতে, পদ্ম পাতার জল -এ এসে যেন তার অভিনয়ে পূর্নতা পেল। এই ছবির ক্যামেরা ম্যান থেকে আরম্ভ করে টি বয় পর্যন্ত সবাইকে সাধুবাদ জানাই এমন গোছানো একটা পারিবারিক পরিচ্ছন্ন ছবি ঈদে উপহার দেবার জন্যে।