Select Page

এক রাতের পাঁচটি পাপ

এক রাতের পাঁচটি পাপ

ওয়েব ফিল্ম: দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা (২০২১); ধরন: এন্থলজি; গল্প: রায়হান রাফী; চিত্রনাট্য: রায়হান রাফী ও নাজিম উদ দৌলা; পরিচালনা: রায়হান রাফী ও সিমিত রায় অন্তর; অভিনয়: নাজিফা তুষি, মনোজ প্রামাণিক, তমা মির্জা, রাশেদ মামুন অপু, খায়রুল বাশার, সামিয়া অথৈ, শরাফ আহমেদ জীবন, নাসির উদ্দিন খান, ফরহাদ লিমন, জাহাঙ্গীর আলম, আর এ রাহুল, মাহাদী হাসান পিয়াল প্রমুখ; প্রযোজনা: কানন ফিল্মস; মুক্তি: ১০ জুন ২০২১; প্ল্যাটফর্ম: আই থিয়েটার

আমরা যারা বাংলা কনটেন্টের দর্শক, তারা ‘এন্থলজি’ বিষয়টার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, খুব বেশিদিন হয়নি। কারণ এই ঘরানার কাজ আমাদের দেশে আগে তেমন একটা হতো না। যদিও প্রথম এন্থলজিক্যাল চলচ্চিত্র সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ মুক্তি পেয়েছিল দেশ স্বাধীনেরও আগে (১৯৬৭ সালে)। এরপর ২০১৯ এ এসে মুক্তি পেয়েছে আমাদের নির্মিত দ্বিতীয় এন্থলজি ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’। এই চলচ্চিত্রটি দর্শক-সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা লাভের পর অনেক তরুণ নির্মাতা এই এন্থলজি জনরাকে ঘেঁটে দেখা শুরু করেছে। ‘দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা’ হলো মুক্তির দিক থেকে এ ধারায় তৃতীয় চলচ্চিত্র।

এখানে মোট ৫টি গল্প রয়েছে; একেকটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১২-১৫ মিনিট। প্রতিটি গল্পই একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত। অর্থাৎ একটি গল্প যেখানে শেষ হচ্ছে, ওই একই পরিবেশে পরের গল্পটি শুরু। এই ট্রিটমেন্ট বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। কারণ গল্প বলার জন্য নির্মাতারা শুরু থেকেই একরকমের রগরগে পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন, যেন আমরা ওই পরিস্থিতি ভালোভাবে অনুভব করতে পারি। আমরা তুলনামূলক সহজে সেই পরিবেশের মধ্যে নিজেকে জুড়ে দেই। সেই একই পরিবেশে অন্য একটি গল্প শুরু হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে না। মাঝেমধ্যে আমরা টেরও পাই না, কখন একটি গল্প শেষ হলো, আর কখন শুরু হলো। গল্পের টাইটেল না দেখানো পর্যন্ত এই রেশ বিরাজ করে।

পাঁচটি গল্পের মধ্যে চারটির নির্দেশনা দিয়েছেন রায়হান রাফী।

ক. আয়না বিবির পালা

এই গল্পের মূল চরিত্রে ছিলেন নাজিফা তুষি ও মনোজ প্রামাণিক। বিত্তশালীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে সিনেমাটিক স্টাইলে দুই প্রেমিক যুগলের অর্থ উপার্জনের ধান্দা, সেই ফাঁদ গড়তে গিয়ে একসময় নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে পড়ে, এ নিয়ে এই গল্প। তুষি-মনোজের দুর্দান্ত অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, সেট ডিজাইন, আর্ট নির্দেশনা ইত্যাদি এই গল্পের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক।

খ. পালাবি কোথায়?

মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন শরাফ আহমেদ জীবন। ‘আয়না বিবির পালা’ যেখানে শেষ হয়, ‘পালাবি কোথায়?’ সেখান থেকেই শুরু হয়। মিথ্যা-বানোয়াট কথা বলে টাকা বাগিয়ে নেওয়া এক অসৎ লোককে আরেক দুষ্টচক্রের হাতে পড়তে দেখা যায় এই গল্পে। শরাফ আহমেদ জীবনসহ অন্যান্যদের স্বাভাবিক অভিনয় এই গল্পের আকর্ষণীয় দিক।

গ. গোলাপী এখন ঢাকায়

তমা মির্জাকে একজন অসহায় যৌনকর্মীর চরিত্রে দেখা যায়। চরিত্রটি বেশ ব্যতিক্রমী এবং তমা মির্জার পারফরম্যান্স বলা যায় অসাধারণ! অন্যান্য চরিত্রে যারা ছিলেন তারা ঠিকঠাক। প্রথম গল্পটির মতো এই গল্পেও সিনেমাটোগ্রাফি, আর্ট ডিরেকশনসহ অন্যান্য কারিগরি দিকের কাজ খুবই আকর্ষণীয়।

ঘ. বন্ধু আমার

মূল চরিত্রে রাশেদ মামুন অপু। ওয়েব ফিল্মে থাকা অন্য চারটি গল্পকে একসঙ্গে জুড়তে সাহায্য করছে এই গল্পটি। যার কারণে আমরা চলচ্চিত্রটির গোড়া থেকেই অন্যান্য গল্পের পাশাপাশি এই গল্পের মর্গে অবস্থান করা দুই বন্ধুর কথোপকথন শুনতে থাকি। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু বেইমানি, এই গল্পের বিষয়বস্তু।

বাকি থাকা একটি গল্প পরিচালনা করেছেন এই চলচ্চিত্রের সম্পাদনা ও রং বিন্যাসের কাজ করা সিমিত রায় অন্তর।

ঙ. অমানুষ

মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন খায়রুল বাসার ও সামিয়া অথৈ। ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’সহ প্রথম তিনটি গল্প শেষ হওয়ার পর এই গল্পটি শুরু হয়। বন্ধু বা প্রেমিকার অনুপ্রেরণায় স্বেচ্ছায় রক্তদান করতে গিয়ে বিপদে পড়ার গল্প দেখানো হয়েছে এখানে। এ গল্পের শেষাংশ কিছুটা অবাস্তব মনে হয়েছে। পাশাপাশি যারা সাধারণত রক্তদান করতে আগ্রহবোধ করে না, তারা যদি এই গল্প দেখে, এ ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ আরও বিনষ্ট হতে পারে।

‘দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা’র পাঁচটি গল্পের নামকরণ বেশ ইন্টারেস্টিং। খেয়াল করলে দেখবেন, রায়হান রাফীর নির্মিত চারটি গল্পের (আয়না বিবির পালা, পালাবি কোথায়?, গোলাপী এখন ঢাকায়, বন্ধু আমার) নামই নেওয়া হয়েছে আশি-নব্বই দশকে মুক্তি পাওয়া চারটি জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্রের নাম থেকে।

এই ওয়েব ফিল্মের সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে ছিলেন এ সময়ের চিত্রগ্রাহক রাজু রাজ। এডিট ও কালার করেছেন সিমিত রায় অন্তর, সাউন্ড ডিজাইন করেছেন আরাফাত কীর্তি। আর্ট ডিরেকশনের দায়িত্ব সামলেছেন নাইমা জামান।

একটা সময় ছিল যখন আমাদের নাটক-সিনেমায় রাতে শুট করা সিন খুব কম দেখা যেতো। সম্ভবত কারিগরি জ্ঞান ও সাপোর্ট দুটোই যথেষ্ট না থাকার কারণে নির্মাতারা রিস্ক নিতে চাইতেন না। তা ছাড়া রাতে শুট করা দৃশ্যগুলোর লাইটিং খুব একটা ভালো হতো না। দেখা যেতো স্ক্রিনের সামনে এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার… যে কী হচ্ছে… কে দাঁড়িয়ে আছে… কিছুই বোঝা যেতো না।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো বাংলাদেশি কাজ দেখলাম… যার বেশির ভাগ অংশ অথবা পুরোটাই রাতে শুট করা। ‘দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা’ পুরোটাই রাতে চিত্রায়িত। সবগুলো গল্পই অন্ধকার রাতের। যা জোশ লাইটিং ও সেট ডিজাইনসহ স্বল্প বাজেটের মধ্যে চলচ্চিত্রটিকে প্রিমিয়াম ফিল দিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

এ ছাড়া চিত্রনাট্য ও সংলাপের বেশ কয়েকটি দিক খুবই ভালো ছিল। যেমন এখানে পাঁচটি গল্পেরই শেষে টুইস্ট রয়েছে। তবে টুইস্টগুলো এমন না যে, সবগুলোই আপনার মাথা ঘুরিয়ে দেবে। আবার এমনও নয় যে, সবগুলোই আপনি প্রেডিক্ট করতে পারবেন। কিছু আপনার মাথা ঘুরিয়ে দেবে, কিছু আপনি প্রেডিক্ট করবেন এবং সেটাই হবে। এই বিষয়গুলো দর্শককে গল্পের সঙ্গে জুড়ে রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এই কাজটি করাও খুবই কঠিন, খুবই দক্ষ লেখক হতে হয়, যদি না বিষয়টি ঠিকঠাকভাবে রপ্ত থাকে। রায়হান রাফী ও নাজিম উদ দৌলা কাজটি বেশ ভালোভাবে করেছেন।

আর বেশ কিছু গালিগালাজপূর্ণ সংলাপ শুনতে পাওয়া গেলেও সেগুলো পরিস্থিতি অনুসারে যথেষ্ট অর্থবহ মনে হয়েছে, জোর করে বসানো হয়েছে এমন মনে হয়নি।

এই চলচ্চিত্রের অন্যতম নেতিবাচক দিক হলো দৈর্ঘ্য। আনুমানিক সোয়া এক ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটির মিনিমাম দুই ঘণ্টা সময় প্রাপ্য। এতে গল্পগুলো আরও বিকশিত হতো, চরিত্ররা সময় পেতো। ১৫ মিনিটের গল্পের দৈর্ঘ্যকে টেনে ৩০ মিনিট করা যেতো, এ ক্ষেত্রে গল্পগুলো যথেষ্ট পোটেনশিয়াল ছিল।

রেটিং: ৭.৫/১০


মন্তব্য করুন