Select Page

কেন গান লিখি!

কেন গান লিখি!

 ‘ভাই, একটা গান লিখে কত টাকা আসে?’

প্রায়ই এমন প্রশ্নের মুখে পড়েন গীতিকাররা। খুব সাদামাটা একটা প্রশ্ন হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গীতিকারের তথাকথিত ‘স্ট্যাটাস’ ও প্রশ্নকর্তার তাচ্ছিল্য। গীতিকার সমাজ কী সেই ‘স্ট্যাটাস’ বজায় রাখতে পারছেন!

আমার মতে, না। তারা এসবের ধার ধারেন না। সত্যি কি তাই?

‘টাকার জন্য গান লিখি না’ বা ‘মনের আনন্দের জন্য লিখি’ এমন যুক্তির পক্ষে অনেক গীতিকারই থাকবেন। থাকুন। কিন্তু যারা পেশাদারভাবে (ক্লায়েন্ট ডিমান্ড আছে এমন) এ কাজটি সফলতার সঙ্গে করছেন, তারা কত টাকা পাচ্ছেন গানপ্রতি? এটা কি যথেষ্ট? এতে তারা কি সন্তুষ্ট?

তারা পান খুবই সামান্য, ভদ্রসমাজে তা উল্লেখযোগ্য নয়।

এ নিয়ে তাদের কোনো আক্ষেপ কি কাজ করে? মনে হয় না। সংবাদমাধ্যম গীতিকারের আক্ষেপ তুলে ধরবে সেই সুযোগই নেই। সংবাদমাধ্যমে ‘গীতিকারের মুখ দেখানো’ এক ধরনের অপরাধই বটে! কালেভদ্রে কারও কারও খবর দেখে আমরা আবেগাপ্লুত হই, নিজের বা অন্যদের বঞ্চনার কথা ভুলে যাই। কোনো কোনো প্রজেক্টে নিজের নাম দেখেই খুশিতে আত্মহারা হন গীতিকার, তাদের চাওয়া এতটাই সীমিত।

এসবের মধ্য দিয়েও অনেক ভালো মানের লিরিক উপহার দিচ্ছেন একেকজন, ভাবা যায় না। একটি গানের বাজেট (মিউজিক ভিডিও) যদি ৩ লাখ টাকা হয়, সেখানে গীতিকার পান সবচেয়ে ছোট অ্যামাউন্ট, এ নিয়ে তাদের রীতিমতো গোস্বা করা উচিত, হতাশায় নিমজ্জিত থাকার কথা। কিন্তু তেমন ঘটে কই? এ কারণেই এই ‘সামান্য সম্মানী’ অসামান্য মহিমায় এখানে প্রতিষ্ঠিত, স্বীকৃত। উদাহরণস্বরূপ বলি যে, কয়েক বছর আগে সিনেমায় একটি গানের ভিডিও নির্মাণে প্রযোজক ব্যয় করেছিলেন ২৫ লাখ টাকা, সেই গানের সম্মানী হিসেবে গীতিকার হিসেবে আমি পেয়েছিলাম স্রেফ ৫ হাজার টাকা।

তার পরও কেন গান লিখি! অনেক ভেবেছি। সদুত্তর নেই। লিখতে লিখতে একটা মোহ কাজ করে বা বলা যায় যে, এই ভগ্নপ্রায় শিল্পমাধ্যমটির উন্নতির পেছনে আমিও কিছু অবদান রাখতে চাই। সেই চেষ্টা জারি রাখি অল্প-বিস্তর কাজ করে। হয়তো একটি কাজের ইতিবাচক সাড়া বা সফলতা (এবং ভিউ) পরের ১০টি গানের রসদ। কে জানে!

আমি কীভাবে অবদান রাখতে পারি? এর একটাই জবাব, ভালো ভালো কাজ করে। একটি গান তৈরিতে কয়েকজনের শ্রম, মেধা, অর্থ লাগে। আমি লিখে আমার দায়িত্ব শেষ করি। গানের অন্য অনেক অংশেই আমার ‘হাত’ থাকে না। ফলে গানটি যখন বাজারে আসে, দেখা যায় সেখানে অন্যদের ‘দায়িত্বে অবহেলা’ স্পষ্ট। গান ভালো হয়নি।

আবার ভালো হলেও শ্রোতা-দর্শক সেভাবে গানটি হয়তো গ্রহণই করেন না। সেটার পেছনে ১০টা কারণ থাকতে পারে। আমার (অন্য গীতিকারও) লেখা গানের একটা সাধারণ সমালোচনা হয় এমন যে, সুর ভালো হয়নি বা মিউজিক সময়োপযোগী নয় বা গাওয়া ভালো হয়নি কিংবা ভিডিও নির্মাণে যতœ নেওয়া হয়নি। এসব অসংগতি কারও ইচ্ছাকৃত না হলেও এতে গাফিলতির ব্যাপারটি স্পষ্ট, প্রমাণিত। কেউ কেউ নিজের কাজটি কোনোভাবে শেষ করতে পারলেই বাঁচে, পরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে নিজের বা ইন্ডাস্ট্রির মানোন্নয়ন সবই ব্যাহত হতে বাধ্য।

এসবের মধ্য দিয়েই একজন গীতিকার তার গান লেখার যুদ্ধ জারি রাখেন, বছরের পর বছর। আবার এটিও সত্য যে, গান লেখার প্রাথমিক শর্ত তথা ছন্দ, মাত্রা না বুঝেই কেউ কেউ লিখতে এসে নিজের ও অন্যদের ক্ষতি করছেন। এই ক্ষতি তাৎক্ষণিক চোখে না পড়লেই একটা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে ইন্ডাস্ট্রিতে।

আসা যাক রয়্যালটির প্রসঙ্গে। এই সিস্টেম এখানে দাঁড়ায়নি। এককালীন অর্থপ্রাপ্তিই এখানে একমাত্র ভরসা। রয়্যালটি সিস্টেম কেন প্রতিষ্ঠিত হয়নি এ নিয়ে কিছু গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার, মানববন্ধন হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এ নিয়ে প্রায়ই কথা বলে, নিজেদের সভায়। কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ কবে দৃশ্যমান হবে তেমন কোনো আভাস নেই। ফলে দিনের পর দিন এভাবেই চলছে। রয়্যালটির কথা বাদ, একটি গানের জন্য (এককালীন সম্মানী বাবদ) গীতিকার ন্যূনতম কত টাকা পারিশ্রমিক দাবি করতে পারবেন, এ নিয়েও কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যা দিতে চায়, সেটিই মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে কোনো গীতিকার যদি তার সফলতার বিচারেও একটু বেশি পারিশ্রমিক আশা করেন, তাকে কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়। তাকে ধীরে ধীরে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়। কারণ এখানে বিকল্পের অভাব নেই।


Leave a reply