Select Page

‘চন্দ্রাবতী কথা’র জন্য বাহবা

‘চন্দ্রাবতী কথা’র জন্য বাহবা

২০২১ সালে এসে একজন পরিচালক কীভাবে ৪০০ বছর আগের মানে ১৬০০ শতকের গল্প পর্দায় তুলে ধরেন, এই কৌতূহল নিয়েই ‘চন্দ্রাবতী কথা’ দেখতে হলে গিয়েছিলাম।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীকবি হলেন চন্দ্রাবতী। দ্বীজ বংশীর কন্যা ছিলেন তিনি। জয় আনন্দ নামের এক শিষ্য ছিল তার বাবার, যার সঙ্গে চন্দ্রাবতীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত জয় আনন্দের কারণেই সেই বিয়েটা হয়নি। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চন্দ্রাবতী আর বিয়ে করেননি, লেখালেখি আর শিবের পূজো নিয়েই আমৃত্যু ব্যস্ত ছিলেন।

ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, পুরো কাহিনী গড়গড় করে বলে দেয়ার জন্য আসিনি। যতটুকু বলেছি সেটা এই সিনেমার খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ, কিন্তু এর বিস্তার আরও ব্যাপক। বাংলাদেশে পিরিওডিক্যাল সিনেমা বানানো এমনিতেই বিশাল চ্যালেঞ্জের ব্যাপার, সেখানে সময়কালটা যদি হয় ৪০০ বছরের আগের তাহলে চ্যালেঞ্জটা কোন পর্যায়ে যায় সেটা সহজেই অনুমেয়। এরকম একটা চ্যালেঞ্জ নেয়ার জন্য পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরী ও তার পুরো টিম আলাদাভাবে ধন্যবাদ পাবেন।

‘চন্দ্রাবতী কথা’ সিনেমার নাম শুনলে প্রথমেই মনে হয়, শুধুমাত্র চন্দ্রাবতীর ব্যাপারেই পুরো সিনেমা, তবে সেটা এই সিনেমাতে দেখা যায়নি। ভাটি অঞ্চলের ভূমিপুত্র আর বহিরাগতদের গল্পও আছে এখানে, যেমনটা আছে সেই সময়কার দেওয়ান ও কাজীদের গল্প। দেওয়ানের অবস্থান ও প্রতিপত্তির কারণে সেই সময়কার কাজীরা ন্যায়ের সঙ্গে থেকেও যে খুব একটা সুবিধা করতে পারতেন না, সেই ব্যাপারটাও এই সিনেমাতে ফুটে উঠেছে। সেই সময়কার সাধু ও বয়াতিদের গল্পও আছে এই সিনেমায়।

অনেকটা ফোক ধাঁচের সিনেমা চন্দ্রাবতী কথা ন্যারেটিভের দিক থেকে একেবারেই ভিন্ন ধরনের। এই ন্যারেটিভে আমার মনে হয় না এই দেশে এর আগে কাজ হয়েছে। একটি সিনেমার গল্প বা কাহিনী বর্ণিত হচ্ছে পটচিত্র, পালাগানের মাধ্যমে— এই ব্যাপারটা ২০২১ সালে এসে দেখা বেশ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক সম্ভবত এর কালার টোন, প্রোডাকশন ডিজাইন, কস্টিউম ডিজাইন আর অভিনেতাশিল্পীদের অভিনয়।

ভিন্ন ন্যারেটিভ একদিকে যেমন ভিন্ন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে, তেমনিভাবে এই ভিন্নতা কতজন দর্শকের বোধগম্য হবে- সেটাও একটা প্রশ্ন। মৈমনসিংহ-গীতিকার সংলাপ হুবহু না নিয়ে সেটার আংশিক আর কিছুটা এই সময়ের সংলাপ নিয়ে যতটুকু সম্ভব সংলাপকে বোধগম্য করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরেও সেটা বোঝার মতো জ্ঞান বা পড়াশোনা কতজন দর্শকের আছে, সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। ‘হাইঞ্জাবেলা’ বলে একটা শব্দ আছে সংলাপে, হাইঞ্জাবেলা মানে যে সন্ধ্যাবেলা- সেটা যদি দর্শকের জানা না থাকে তবে তিনি এই সিনেমার সঙ্গে কানেক্ট করতে কিছুটা হলেও ব্যর্থ হবেন। এরকম আরও নানান ধরনের সংলাপ আর শব্দ আছে সিনেমায়, যা থাকাই স্বাভাবিক। তবে সিনেমাতে ইংরেজি সাবটাইটেল যোগ করা গেলে এই সমস্যা অচিরেই দূরীভূত হবে। এই ব্যাপারে সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

অভিনেতারা সবাই যার যার জায়গায় ঠিকঠাক কাজ করেছেন, সেটা সম্ভবত দুই মাস রিহার্সেল করার কারণেই। অনুদানে নির্মিত এই সিনেমা শুটিং হয়েছে প্রায় ৫৫ দিন ধরে, পুরোটা সময় অভিনেতারা যেন সেই ১৬০০ শতকের সময়ই বাস করছিলেন। গাজী রাকায়েত, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আরমান পারভেজ মুরাদ- এদের নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে নবীনদের নিয়েও আলাপের জায়গা রয়েছে, সেটা দিলরুবা দোয়েল, ইমতিয়াজ বর্ষণ, জান্নাতুন নূর মুন বা কাজী নওশাবা আহমেদ। আলাদা করে বলতে চাই, তনয় বিশ্বাসের কথা। এই অভিনেতার কোন কাজ পূর্বে দেখা হয়নি, তবে নিজের চরিত্রের প্রতি তার ডেডিকেশন দেখার মতো।

‘চন্দ্রাবতী কথা’ ত্রুটিমুক্ত সিনেমা নয়। সিনেমার ফার্স্ট হাফে সেভাবে চন্দ্রাবতীকে পাইনি, যেমনটা পেয়েছি সিনেমার সেকেন্ড হাফের শেষের দিকে। ১ ঘন্টা ৪৪ মিনিটের এই সিনেমার রানিং লেন্থ আরেকটু বড় হলে দর্শক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আরেকটু খুশি হতাম। ইমতিয়াজ বর্ষণের আবেগঘন অনেক দৃশ্যে ক্লোজ শট নিলে হয়ত আরও বেশি ইনভলভড হতে পারতাম দর্শক হিসেবে। এতকিছুর পরেও নিরাপদ রাস্তায় না হেঁটে পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরী যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রাস্তায় হেঁটেছেন, সেজন্য তিনি বাহবা পাবেন। আলাদা করে প্রশংসা পাবেন এই সিনেমা প্রোডাকশন ডিজাইনার, অনেকদিন পর কাঁসার থালা দেখানোর জন্য আর কস্টিউম ডিজাইনার, নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে করার জন্য কোন যথার্থ রেফারেন্স না থাকার পরেও।

ভিন্ন কিছু দেখার ইচ্ছে থাকলে, ভিন্ন কিছুর স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছে থাকলে, ভিন্ন চেষ্টাকে সাধুবাদ দেয়ার মত মন মানসিকতা থাকলে ‘চন্দ্রাবতী কথা’ দেখতে পারেন। আজ থেকে ৪০০ বছর আগের সময়কে যেভাবে এই সিনেমা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, সেটা এক দলিল হিসেবে থেকে যাবে।


মন্তব্য করুন