Select Page

জহিরুল হকের সিনেমা দেখে দর্শকেরই ‘বিজয়’

জহিরুল হকের সিনেমা দেখে দর্শকেরই ‘বিজয়’

১৯৮৯ সালে পরিবারের সঙ্গে সিলেটের নন্দিতা সিনেমা হলে মতিন রহমানের ‘রাঙাভাবী’ ছবিটা দেখছিলাম। বিরতির পর একটা ট্রেলার দেখে মাথা নষ্ট হয়ে গেল। যে ছবিটাও শাবানার; শুধু নায়কের জায়গায় জসিম খসরু। আসছে সপ্তাহ থেকে ছবিটি প্রদর্শিত হবে।

‘রাঙাভাবী’র মতো এতো দারুণ একটা ছবি দেখার পরেও বারবার আমার কিশোর মনে ট্রেলারের ছবিটার কথা ঘুরে-ফিরে আসছিল। জঙ্গলের ভেতর শাবানার দৌড়ে যাওয়া, জসিমের অ্যাকশন, খসরু ও এক শিশুশিল্পীর মোটর সাইকেলে চড়ে গান, শাবানার আনন্দের হাসি, দুঃখের অশ্রু সবকিছু বারবার চোখে ভেসে উঠছিল। জানি ছবিটা আসলে এমনিতেই দেখতে যাবো তারপরও মায়ের কাছে বায়না যেন প্রথম দিনেই দেখতে যায়। অবশেষে গেলাম, তবে প্রথম দিন নয় ষষ্ঠ দিনে— যেন ভিড় একটু কম হয়। যা ভেবে এতো দেরিতে যাওয়া সেই ভাবনা কাজে লাগেনি অর্থাৎ ভিড় যেন প্রথম দিনের মতোই।

ট্রেলার দেখে যে ছবির প্রেমে পড়েছিলাম সেটির নাম ‌‘বিজয়’। বাংলার চলচ্চিত্রের সামাজিক অ্যাকশন ছবির রূপকার জহিরুল হকের পরিচালনায় এটি ছিল আরেকটি জমজমাট ছবি। এই জহিরুল হকের ‘সারেন্ডার’ ছবিটির কথা আগেই বলেছিলাম, আজ সংক্ষেপে ধারণা দেবো ‘বিজয়’ সম্পর্কে।

সুপারহিট ‘সারেন্ডার’-এর মতো ‘বিজয়’ও ‘একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত’ যা পরিচালক ছবির শুরুতেই টাইটেলে জানিয়ে দেন।

গল্পটি এমন—বাবা মারা যাওয়ার আগে জসিমকে অনেক বেশি স্নেহ ও বিশ্বাস করে বিষয় সম্পত্তির প্রায় পুরোটাই লিখে দেন, যা নিয়ে দুই সৎ ভাই (মঞ্জুর রাহি, মাহবুব খান গুই) ভীষণ ক্ষিপ্ত। জসিম তাদের খুশি রাখতে শহরের সব বিষয় সম্পত্তি দিয়ে শুধুমাত্র চা বাগানটি নিজের জন্য রেখে সংলগ্ন বাংলোয় বসবাস করতে থাকে। ভালোবেসে জসিম বিয়ে করে শাবানাকে । শহর ছেড়ে, সৎ ভাইদের ছেড়ে চা বাগান ও ঘন অরণ্য জসিম-শাবানার দিন কাটছিল বেশ সুখেই।

বন্ধু সিদ্দিক জামাল নান্টু জসিমের খুবই বিশ্বস্ত। শাবানার পর নান্টু তার সবচেয়ে আপন। এতকিছু পেয়েও জসিমের সৎ ভাইয়ের নারাজ। তাদের ধারণা চা বাগান সবচেয়ে বেশি লাভজনক তাই জসিম তাদের বোকা বানিয়ে নিজের করেই রেখেছে। এবার তারা জসিমকে হত্যা করে চা বাগানটি নিজেদের মালিকানায় নিতে মরিয়া হয়ে উঠে। গর্ভবতী শাবানাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পথে ভাড়াটে খুনি জাম্বু ও তার দল দুজনকে আক্রমণ করে। শাবানা অজ্ঞান হয়ে যায় আর জসিমকে আধমরা করে মৃত ভেবে নদীতে ফেলে দেয়।

খবর পেয়ে শাবানাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় নান্টু। সুস্থ হওয়ার পর শাবানা জানতে পারে জসিম মারা গেছে। তার কোল জুড়ে আসে পুত্র সন্তান। এ দিকে মাহবুব খান ও তার দলের লোকজন বাগান দখল নিতে এলে নান্টু ও শ্রমিকদের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায়। তারপরও ছায়ার মতো শাবানার পিছে লেগে থাকে হত্যা করার জন্য। একদিন বন বিভাগে বদলি হয়ে আসে ফরেস্ট অফিসার খসরু। বনে গাছ কাটার চক্রের বিরুদ্ধে মাঠে নামে খসরু। নান্টু সব খুলে বলে; কারা কেন কীভাবে এই বাগানের গাছ কেটে পাচার করতে বারবার হানা দেয়। নান্টু শাবানাকে বিভিন্নভাবে বুঝাতে থাকে যে মৃত জসিমের এই সম্পত্তি ও ছেলেকে বাঁচাতে হলে তার পাশে একজন সাহসী মানুষ থাকা প্রয়োজন। নান্টুর কথায় শাবানা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই খসরুকে বিয়ে করতে রাজি হয়। বাসর ঘরে খসরুকে সব খুলে বলে শাবানা জানায়, জসিমকে আজো ভুলতে পারেননি ও পারবেনও না। তাই যতদিন না পর্যন্ত তিনি মন থেকে খসরুকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে না। খসরুও রাজি হয় এবং শাবানাকে জীবনের পেছনের কথা খুলে বলে—অন্য একজন ভালোবেসে ছিলেন যাকে বিয়ে করা হয়নি। জীবনে বিয়ে করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু শাবানার ছোট্ট সন্তানটির প্রতি মায়া লেগে যায়, তাই তাদের পাশে থাকার জন্যই বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন।

কয়েক বছর পর জসিম ফিরে আসে নিজ এলাকায়। কিন্তু ততদিনে যা ঘটার তাই ঘটে গেছে। জসিম মারা গেছে ভেবে এরপর কী কী ঘটেছিল সবকিছু নান্টু খুলে বলে এবং শাবানাকে কেন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল সব জানার পর জসিম নিজেকে গোপন করে রাখে। নান্টু ছাড়া আর কেউই জানে না জসিম বেঁচে আছে। একদিন খসরুকে বাঁচাতে যাওয়ায় জসিমের সঙ্গে পরিচয় হয়। কিন্তু খসরু জানে না এই সেই জসিম যে শাবানার স্বামী ও শিশু মুন্নার বাবা। … এভাবেই উত্তেজনায় ঠাসা গল্পটি খসরুর মৃত্যু ও জসিম-শাবানার পুনর্মিলন দিয়ে শেষ হয়।

পুরো ছবিটি চিত্রায়িত হয়েছিল হবিগঞ্জের চা বাগানের দুর্গম এলাকায়। বিদেশী গল্প হলেও পুরো ছবিতে ছিল বাংলাদেশের ছাপ, বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ। বলতে গেলে ‘সারেন্ডার’-এর পর বিদেশি গল্পের আরও একটি সফল ছবি নির্মাণ করেন কাহিনীকার ও অভিনেতা সিদ্দিক জামাল নান্টু ও পরিচালক জহিরুল হক।

ছবিতে শাবানা এককথায় দারুণ জসিম তার মতোই অসাধারণ ছিলেন। খলনায়ক হিসেবে মাহবুব খান গুই, মঞ্জুর রাহি ও জাম্বুর রসায়নও দারুণ ছিল।

‘সারেন্ডার’-এর সফলতায় নান্টু মুভিজ বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে ‘বিজয়’ নির্মাণ করে তা বোঝা গিয়েছিল। খুব সহজ-সরলভাবে ঘটনার পরম্পরায় দৃশ্যের পর দৃশ্য দিয়ে বেশ শক্ত গাঁথুনি ছিল। গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করতে কোন কিছুতেই কার্পণ্য করেননি পরিচালক।

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ও আলম খানের সুর করা গানগুলোও ছিল দারুণ। তবে সবচেয়ে সুপারহিট গানটি ছিল খসরুর ঠোঁটে এ্যান্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে ‘জীবনটা যেন এক রঙের মেলা’। যে গানটিতে জীবনের কিছু চিরন্তন কথা তুলে ধরেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলম খান করেছিলেন মনে গেঁথে যাওয়ার মতো সুর। গানটির চিত্রায়নও ছিল কথার সঙ্গে মিলে রেখে।

সব মিলিয়ে সিদ্দিক জামাল নান্টুর লেখা গল্পটিকে সার্থকভাবে সিনেমায় রূপান্তর করেছিলেন পরিচালক জহিরুল হক; যা আজো স্মৃতির পটে ভেসে উঠে বারবার।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন