Select Page

দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির ভুলে শত পরিবারের আজীবন কান্না!

দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির ভুলে শত পরিবারের আজীবন কান্না!

একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাবো— আমাদের ঘরে পুরাতন একটি ন্যাশনাল ৫৪৩ টু ইন ওয়ান ছিল। বিজ্ঞাপন তরঙ্গ, অনুরোধের আসর নন্দিতা ও সমাহারে গানটি প্রায় শুনতাম। আজিজুর রহমান পরিচালিত নায়করাজ রাজ্জাক, বিউটিকুইন শাবানা, রূপবান-কন্যা সুজাতা ও মাস্টার ইমন অভিনীত মাস্টারপিস ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির গান। স্কুলে পড়াতাম, তাই গানটি ভীষণ ভালো লাগতো। আমি তখন ক্লাস টু-তে পড়ি, আমার নতুন ভাবির মুখে প্রথম ‘ছুটির ঘণ্টা’র কাহিনি শুনি।

মাস্টার সুমন

তিনি বলেছিলেন, ছায়াছবিটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। সেই ছেলেটির জন্য অনেক কেঁদেছিলাম, ভাবিও কাঁদছিলেন।

এর অনেক বছর পর নগরীর স্বপ্নপুরী বনানী কমপ্লেক্সে ‘ছুটির ঘণ্টা’ দেখেছিলাম। ছবিটি মুক্তির আট-নয় বছর পরও দর্শকপ্রিয়তা দেখে অবাক হয়েছিলাম। প্রচুর দর্শক ছিল সেদিন।

ছবিটি দেখার পর আমি ও অনেক দর্শক কাঁদতে কাঁদতে সিনেমা হল থেকে বের হয়েছি।

নীলগিরি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি আব্বাস (রাজ্জাক) তার গ্রাম্য ভাই (রবিউল) দ্বারা স্কুলের সামনে আচারের ব্যবসা পরিচালনা করে। স্কুলের ঝাড়ুদারনি আঙ্গুরি বালার (শাবানা) সঙ্গে আব্বাসের খুনসুটি লেগেই থাকে। তারা একই বস্তির বাসিন্দা।

আপনজনহীন আব্বাস আঙ্গুরি বালাকে পছন্দ করে। আঙ্গুরি বালাও মনে মনে পছন্দ করে, কিন্তু ভাব দেখায় পাত্তা না দেওয়ার।

স্কুলের মেধাবী ছাত্র আসাদুজ্জামান খান খোকন (মাস্টার সুমন)। বাবা প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত, মা মিজ খান (সুজাতা) স্বামীর বিশাল ব্যবসা পরিচালনা করেন।

মিজ খান দায়িত্বশীল ও স্নেহময়ী মা, খুব নরম মনের মানুষ। গরিব দুঃখীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। দপ্তরি আব্বাসকে প্রায় আর্থিক সাহায্য করে থাকেন। আব্বাসও সব সময় কৃতজ্ঞ থাকে। তার ও খোকনের সম্পর্ক খুবই মধুর। ধনী-গরিবের অপূর্ব সম্পর্ক, কোনো ভেদাভেদ নাই।

নানা (শওকত আকবর) এসেছে খোকনের বাসায়। ক’দিন পর ঈদুল আজহা উপলক্ষে স্কুল ছুটি দেবে। এবার কোরবানের ঈদ খোকন মায়ের সঙ্গে নানার বাড়িতে উদ্‌যাপন করবে।

ছুটির আগে স্কুলের শেষদিন খোকনের রাজ্যের আলসেমি, তাই স্কুলে যেতে চায়নি। কিন্তু মা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠালো।

ঈদ উপলক্ষে স্কুল ১১ দিনের বন্ধ দিলো এবং স্কুলে অর্ধদিবসে ছুটির ঘণ্টা বাজলো। খোকন বেস্ট ফ্রেন্ডদের সঙ্গে স্কুল থেকে বের হয়ে এলো। আচারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল। সবাই দেখেছে। কিন্তু খোকনকে নিতে গাড়ি তখনো আসেনি। এক-এক করে সবাই চলে গেলো, তখন স্কুল মাঠে একা।

হঠাৎ খোকনের টয়লেট যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সে স্কুলে প্রবেশ করে, টয়লেটে যায়। দপ্তরি আব্বাস স্কুলের সব রুমে তালা লাগিয়ে, শেষে বাথরুমের তালা লাগিয়ে দিলো। বাথরুমের ভেতর যে কয়েকটি শৌচাগার ছিল, একটিতে খোকন ছিল। আব্বাস ভেতরে চেক না করে দায়িত্বহীনভাবে তালা লাগিয়ে দিলো।

খোকনকে না পেয়ে মা, নানা চারদিকে খোঁজ করতে থাকে। ঝাড়ুদারনি আঙুর বালা, আচারওয়ালা, খোকনের বন্ধুরা সবাই দেখেছে খোকন স্কুলের বাইরে। গাড়ির অপেক্ষা করতে। সবাই বুঝলো খোকন হারিয়ে গেছে অথবা ছেলেধরায় নিয়ে গেছে। তখন ছেলে ধরার খুব উপদ্রব ছিল। কেউ খোকনকে খুঁজে পায় না।

এগারোদিন খোকন স্কুলের বাথরুমে আটকা পড়েছিল। চার দিন শুধু পানি খেয়ে ছিল। এর পর পানি শেষ হয়ে যায়। খোকন টাকা খেয়েছে, বইয়ের পাতা খেয়েছে, খাতার কাগজ খেয়েছে। আটকে পড়া দিনগুলোর অভিজ্ঞতা বাথরুমের দেয়ালে দেয়ালে লিখে গেছে। তারপর না ফেরার দেশে চলে যায়।

রাজ্জাক ও শাবানা

আব্বাসের দায়িত্বহীনতার জন্য খোকনের এই করুণ মৃত্যু হয়। পৃথিবীতে মানবসৃষ্ট যত দুর্ঘটনা আছে, সবই দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলা আর অসতর্কতা কারণে হয়েছে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ ছুটির ঘণ্টা’ আমাদের এটা শিখিয়ে দিলো, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির একচুল পরিমাণ অসতর্কতা কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে! কিন্তু আমরা কি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেছি?

আমরা প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো দায়িত্বে আছি। হোক সেটা পারিবারিক বা সামাজিক অথবা রাষ্ট্রীয়। আমরা কি আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি?

যদি করে থাকি, তাহলে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে এত বিশৃঙ্খলা কেন?

রাজ্জাক, সুজাতা, মাস্টার সুমন নিজের প্রতিভা যেন ঢেলে দিয়েছে এই সিনেমায়। সুমনের আটকে পড়া অবস্থায় প্রতিটি সংলাপ হৃদয় থেকে রক্ত ঝরিয়েছে।

এ যেন সিনেমা না, করুণ মহাকাব্য। পরিচালক আজিজুর রহমান যে কত বড় মাপের চিত্র পরিচালক তা ‘ছুটির ঘণ্টা’ই প্রমাণ। দেশ-বিদেশের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ‘ছুটির ঘণ্টা’ বিশ্বমানের একটি সিনেমা।


মন্তব্য করুন