Select Page

দুই দুয়ারী হুমায়ূন আহমেদ

দুই দুয়ারী হুমায়ূন আহমেদ

আমি এক দুই দুয়ারীর কথা বলছি। যিনি লিখেছেন আর বানিয়েছেন। লিখেছেন বই আর বানিয়েছেন নাটক ও সিনেমা। তাঁর শেষ সিনেমার আগে বলতে পেরেছিলেন সেটি তাঁর শেষ কাজ। জীবন ও মৃত্য্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি টের পেয়েছিলেন তাঁকে শেষ কাজটি করে যেতে হবে। জীবন ও মৃত্যুর দুই দুয়ারে সেই হুমায়ূন আহমেদ নিজেই হয়ে যান দুই দুয়ারী।

লেখক হুমায়ূন আহমেদের থেকে একজন নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদকে আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ। লেখক হুমায়ূন আহমেদ প্রয়োজনের বাইরেও লিখেছেন কিন্তু নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ খুব হিশেবি। যা বানিয়েছেন পরিমিত এবং সবকিছুই মেীলিক। নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ ভারসাম্য রেখে নির্মাতা নির্মাণ করেছেন নাটক, সিনেমা। তাঁর নাটকে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন আবার সামাজিকভাবে মেসেজও দিয়েছেন।

‘তারা তিনজন’ নাটকটি দেখলে একইসাথে যেমন আপনি এজাজুল ইসলাম, ফারুক আহমেদ ও স্বাধীন খসরুর অভিনয়ে দম ফাটানো হাসি হাসবেন তেমনি বেকারত্ব যে একটা অভিশাপ সেটাও টের পাবেন। এ গুণটা সব নির্মাতার নেই যিনি হাসাতে হাসাতে সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরতে পারেন। বিটিভির কুসুম, সবুজ সাথী, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, বহুব্রীহি, সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড কিংবা এনটিভির উড়ে যায় বকপক্ষী, রুমালী নাটকগুলো জীবন নিয়ে ভাবাত আবার জীবনে Ffনন্দের খোরাক দিত।

নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদকে একটা কথাতেই সামগ্রিকভাবে বলা যায় তা হল তিনি ‘বৈচিত্র্যময়’। তাঁর সিনেমায় তিনি ভারসাম্য রেখেছেন অনেক উপাদানকে এক করে একটা বিনি সুতোর মালা হিশেবে। তিনি যখন ‘আগুনের পরশমনি’ বানান মুক্তিযুদ্ধ তাঁর চেতনাতে থাকে অসাধারণভাবে। মুক্তিযুদ্ধের এত জীবন্ত সিনেমা কমই হয়েছে। আবুল হায়াত,ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর,বিপাশা হায়াত,শিলা সবার অভিনয় ছিল জীবন্ত। মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাঁচানোর জন্য এরকম একঘরে সবাই জড়ো হয়ে থাকার বাস্তবতা বাবার মুখে আমিও কত যে শুনেছি। সিনেমার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন অসাধারণভাবে দেখানো হযেছে। যে মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে সে তখন তার স্ত্রীর সাথে কাটানো রঙিন মুহূর্তগুলোর কথা ভাবছে এরকম অনেক আবেগ বা স্বপ্ন আছে সিনেমাতে।

‘শ্যামল ছায়া’ও একইরকম। যে শ্যামল ছায়া সিনেমার নামটিকে এত চমৎকার কাব্যিক করেছে তার মধ্যে তিনি দেশপ্রেমকে বোঝাচ্ছেন গভীরভাবে।

‘দুই দুয়ারী’ সিনেমার যে রহস্যমানব রিয়াজ তার ছলে হুমায়ূন আহমেদ দেখান একজন প্রেমিকার জীবনে দুজন মানুষকে মনে মনে চাওয়ার একটা নিখুঁত মনোবাস্তবতা। এর সাথে আরো আছে জীবন-মরণ দুই দুয়ারে দাঁড়ানোর মেডিটেশন যেখানে রিয়াজ ও মাহফুজ দুজন উপাদান। জীবন যে সুন্দর এটাই বলতে চেয়েছেন লেখক বা নির্মাতা।

‘চন্দ্রকথা’ খুব সহজে স্পর্শ করে তার অসাধারণ সব গান আর প্রেমের উপস্থাপনা দেখে।

‘শঙ্খনীল কারাগার’ সেই ছোটবেলায় প্রথমাবার বিটিভিতে দেখার সময়ই ভালো লেগে যায়। মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপড়েন সংসার থেকে শুরু করে বাইরের জগত পর্যন্ত কীভাবে বিস্তৃত হয় সিনেমাটি দেখায়। সুবর্ণা মুস্তাফার জীবনের বাস্তবতায় মধ্যবিত্ত কন্যা দায়গ্রস্ত অনেক মেয়ের কথা মনে পড়বে। যেভাবে ছোটবোনের বিয়েতে বড়বোন অপমানিত হয় বা বড়বোনকে রেখে ছোটবোনকে বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলে সে বাস্তবতা আমাদের সমাজে প্রকট। নাজমা আনোয়ারের অনবদ্য অভিনয় আজো মনে পড়ে।

‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ যে দর্শক দেখেনি তার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। জমিদারপ্রথার অহংকারের সাথে গ্রামীণ সংস্কৃতির জীবন ও সঙ্গীতসাধনা অনবদ্য হয়ে আছে এ সিনেমায়। জাহিদ হাসান, মাহফুজ ও শাওন এ তিনটি চরিত্র ভোলা যায় না। ভোলা যায় না মাটির জানালায় এক টুকরো চাঁদের মতো শাওনের মুখ যার নাকে ছিল নথ আর পরম যত্নে মাহফুজ গান ধরেছিল ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’। আমাদের সিনেমার কালজয়ী গান এখন সেটি।জাহিদ হাসানের মুখে বারি সিদ্দিকীর কালজয়ী গান ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ আজও সবার প্রিয় কিংবা জাহিদ হাসানের হেলেদুলে গায়েন দলের সাথে গাওয়া ‘ওলো ভাবীজান নাও বাওয়া মদ্দলোকের কাম’ গানটি লোকসংস্কৃতির অনন্য সংযোজন।

‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ সেই স্যাটায়ার সিনেমা যেখানে শেষ বয়সে বাবাকে সন্তানরা অবহেলা করে আর সন্তানের জন্য থাকে লজ্জা। আনন্দফূর্তির মাধ্যমে জীবনের বাস্তবতাকে স্পর্শ করাই ছিল হুমায়ূনের কাজ। এ সিনেমার ‘চলোনা যাই বসি নিরিবিলি’ গানটি খুবই প্রিয়।

‘ঘেটুপুত্র কমলা’ তো বুকটা চিরে দেখানো সমাজের পাপী লোকদের ঘটনা যেখানে খেলার পুতুল বানানো হয় একটা ছেলেকে যে নিচুজাতের হয়ে অন্যায় করেছে।অসাধারণ সিনেমা।

এমন আরো অনেক উপাদানে হুমায়ূন আহমেদ মেীলক নির্মাতা….

মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই হে চন্দ্র কারিগর।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন