Select Page

‘নাজমা’র মতো স্ত্রী থাকলে পুরুষ বিপথে যেতে পারে না

‘নাজমা’র মতো স্ত্রী থাকলে পুরুষ বিপথে যেতে পারে না

১৯৮৬ এর কোনো এক শুক্রবার, শীতের বিকাল। আমি বিকাল তিনটায় নূপুর সিনেমায় যাই। হাফপ্যান্টের পকেটে ছয় টাকা। পাঁচটাকা দিয়ে টিকেট কিনবো আর একটাকা দিয়ে বিরতির সময় মটর ভাজা খাবো।

আমার জানা ছিল না কোন ছবি চলছে, যেয়ে দেখি নাম ‘নাজমা’।

ছবির পরিচালক সুভাষ দত্ত। এর আগে সুভাষ দত্তের ছবি দেখিনি। তবে এই নাম আমার পরিচিত। ফিরিঙ্গি বাজারের এক ছেলে আমার ক্লাসমেট ছিল। তার পাশের বাসায় মিনা পাল থাকতো। যার মূল বাড়ি বোয়ালখালি কানুনগো পাড়া। সেই মিনা পালকে অনেক বছর আগে সুভাষ দত্ত নামে এক সিনেমাওয়ালা নায়িকা বানায়। যার সিনেমার নাম কবরী। এমনই গল্প শুনতাম আমার ক্লাসমেটের মুখে।

সোয়া তিনটায় ছবি শুরু হলো। কাহিনি এমন; রাজ্জাক বিচারক বাপের টাকায় ফুর্তি করে চলে। তার একটি মানবিক গুণ আছে, অসহায় ব্যক্তিকে দান করে।

রাজ্জাকের উপর বাবা মোস্তফা খুব বিরক্ত। কাজকর্ম করে না। বাপের টাকা দিয়ে ক্লাবে ফূর্তি করে। রাজ্জাকের মা নাই, তাই সব সহে গেছে, কিন্তু আর কতো!

শাবানা ধনীর দুলারী, নাম নাজমা। বাবা আনোয়ার হোসেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। শাবানা একদিন বান্ধবী সুলতানার সাথে ক্লাবে আসে। সেখানে রাজ্জাকের সাথে পরিচয়। রাজ্জাক প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যায়। শাবানার প্রেম পেতে সে নানা ছলনার আশ্রয় নেন।

রাজ্জাকের বন্ধু প্রবীর মিত্র এবং শাবানার বান্ধবী সুলতানা এইসব ছলনার অংশিদার ছিলেন। এক সময় শাবানা রাজ্জাকের প্রেম হয়ে যায়। তারা একে অপরকে জীবন সঙ্গী করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

আনোয়ার হোসেন শাবানার বিয়ে জসিমের সাথে ঠিক করেন। জসিম ভদ্রবেশী চোরাকারবারি। শাবানা যখন বিষয়টি জানালে রাজ্জাক তার বাড়িতে যেয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন। একরোখা আনোয়ার হোসেন রাজ্জাকের প্রস্তাব দাম্ভিকতার সাথে নাকচ করে দেন। রাজ্জাক তখন শাবানাকে নিয়ে বের হয়ে কাজী অফিস যায়। তারা বিয়ে করে।

আনোয়ার হোসেন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তিনি জসিমকে বলেন, যদি শাবানাকে ছিনিয়ে আনতে পারে, তাহলে তার সাথে বিয়ে দেবেন। সাথে সমস্ত সম্পত্তি। জসিম গ্যারান্টি হিসাবে লিখিত চায়। আনোয়ার হোসেন জসিমের সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে।

কিন্তু জসিম গ্রেফতার হয়ে যায়। জসিম নানা অপরাধের সাথে জড়িত ছিলো। জসিমের দশ বছরের জেল হয়।

রাজ্জাক শাবানাকে নিয়ে নিজবাড়িতে যায়। বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সদ্যবিয়ে করা স্ত্রীকে। মোস্তফা তাদের ঘর থেকে বের করে দেয়।

মোস্তফা এই নিষ্ঠুর কাজটি রাজ্জাকের ভালোর জন্য করেছে। মোস্তফা বুঝতে পারছিল, রাজ্জাক দিনদিন বাপের টাকা নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। এবার যেন নিজপায়ে দাঁড়াতে পারে। ভেতরে ভেতরে মোস্তফা কষ্ট পেলেও বাহিরে ভীষণ কঠোর।

রাজ্জাক শাবানাকে নিয়ে একটি বস্তিতে বাসা ভাড়া করে থাকে। উচ্চশিক্ষত রাজ্জাক মামার জোর ছাড়া চাকরি পাচ্ছিল না। বাবার পরিচয়ও দিচ্ছিল না। যাও একটা চাকরি পেল, শ্বশুর আনোয়ার হোসেনের আপত্তিতে প্রথম দিনেই বরখাস্ত হলো।

শাবানার মা রোজী আফসারী তাদের খুঁজে বের করে। তারপর সব আসবাবপত্র নিয়ে আসে। শ্বশুরবাড়ি থেকে এইসব উপহার রাজ্জাকের আত্মসম্মানে লাগে। রাজ্জাক আপত্তি জানালে রোজী আফসারী ফেরত নেয়। রাজ্জাকের আত্মসম্মানবোধ দেখে খুশি হয়।

রাজ্জাক এক ব্রিফকেস টাকা কুড়িয়ে পায়। অভাবে জর্জারিত ক্ষণিকের জন্য নীতি-আদর্শ ভুলে যায়। আত্মসাৎ করতে চায় সব টাকা। শাবানা বিরোধীতা করে। ফিরিয়ে আনে রাজ্জাকের নীতি-আদর্শ। রাজ্জাক অনুতপ্ত হয়।

রাজ্জাক টাকার মালিকের কাছে টাকা ফেরত দেয়। টাকার মালিক ব্রিফকেসের সব টাকা রাজ্জাককে দিতে চায়। রাজ্জাক গ্রহণ করে না। রাজ্জাকের একটি চাকরি চাই। তিনি সবশুনে তখন রাজ্জাককে সাব- কন্ট্রাক্টারি দেয়। রাজ্জাক এ কাজ করে এক সময় ভালো অবস্থানে আসে।

ততদিনে রাজ্জাক-শাবানা আট, নয় বছরের সন্তানের মা-বাবা। পিতা-পুত্রের মিটমাট হয়, শ্বশুর-জামাইয়ের মিটমাট হয়। তারা সুখে-শান্তিতে ঘর সংসার করতে থাকে। কাহিনী এখানেই শেষ নয়, আরো আছে!

জসিম দশ বছর পর জেল থেকে মুক্তি পায়। মুক্তি পেয়েই আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে যায়। স্বাক্ষর করা কাগজ দিয়ে আনোয়ার হোসেনকে ব্ল্যাকমেইল করে। শাবানাকে বিয়ে করতে চায়। শাবানাকে বিয়ে করা মানে সব সম্পত্তির মালিক হওয়া। জসিম তখন নিঃস্ব প্রায়।

আনোয়ার হোসেন জসিমকে বল, তখন আমি রাগের বশে করেছি, যা করেছি। আমাদের এখন মিটমাট হয়ে গেছে। নাজমা সুখে আছে। তাঁর আট বছরের বাচ্চা আছে।

জসিম মানতে নারাজ। কথা কাটাকাটির এক পর্যায় জসিম নিঃশব্দে গুলি করে আনোয়ার হোসেনকে। বাপি (রাজ্জাক-শাবানার ছেলে) হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ স্বাক্ষী।

এরপর জসিম রাজ্জাককে জাল কাবিন দেখিয়ে শাবানাকে স্ত্রী হিসাবে দাবী করে। রাজ্জাক জাল প্রমাণপত্র দেখে বিশ্বাস করে, রাগে-দুঃখে অন্ধ হয়ে যায়। জসিমকে বলে বাসায় আসতে। শাবানাকে জসিমকে দিয়ে দিবে। জসিম রাতে আসে। রাজ্জাক শাবানার সাথে খুব দুর্ব্যবহার করে। শাবানাকে চড় মারে। শাবানা সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে ফ্লোরে পড়ে মাথায় আঘাত পায়। স্বামীর অবিশ্বাস আর আঘাতে শাবানা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।

বাপি জসিমকে দেখে বলে রাজ্জাকে, এই নানার খুনি। রাজ্জাক বুঝতে পারে জসিমের এইসব ষড়যন্ত্র। জসিমকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে।

শাবানা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে, বাসা থেকে বের হয়ে বনানী স্টেশন আসে। বনানী স্টেশন থেকে থার্টি ফোর ডাউন ট্রেনে উঠে। ট্রেন যখন চট্টগ্রাম জেলার মাস্তান নগর আসে, তখন শাবানা নেমে যায়।

পাহাড় ঘেরা মান্তান নগর স্টেশনের প্লাটফরমে থাকে শাবানা। ঘটনাক্রমে বাপি মাস্তান নগর আসে।

মা’কে বাপি খুঁজে পায়। স্টেশনের মাস্টার প্রবীর মিত্র। প্রবীর মিত্র স্ত্রী সুলতানাকে নিয়ে সরকারি কোয়াটারে থাকে।

সবার সাথে পরিচয় হয়, শাবানা সুস্থ্য হয়। রাজ্জাক আসে। ছবি সমাপ্ত হয়।

অনেক দিনের স্মৃতি থেকে লিখেছি, কাহিনী একটু এদিক-সেদিক হতে পারে।

এই কাহিনী থেকে শেখার আছে অনেক কিছু—

এক. সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। বাপের টাকায় বাহাদুরি করলে সন্তান এক সময় পঙ্গু হয়ে যায়। পরনির্ভরতা পঙ্গুত্ব ছাড়া আর কি!

মোস্তফা তাই রাজ্জাকের সাথে কঠোর হয়েছিল। যাতে রাজ্জাক তার শিক্ষা-যোগ্যতা দিয়ে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারে।

মোস্তফা সফল হয়েছে, রাজ্জাক কঠোর পরিশ্রম করে, সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মোস্তাফা যদি পিতৃস্নেহে অন্ধ হয়ে রাজ্জাকের সব আব্দার মেনে নিতো। তাহলে রাজ্জাক জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতো না।

দুই. রাগের বশবর্তী হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে নাই। রাগলেন তো হারলেন। আনোয়ার হোসেন রাগের বশবর্তী হয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই সিদ্ধান্তের কারণে, দশ বছর পর নৃশংসভাবে খুন হতে হয়।

সন্তান যদি ভুল করে, ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। রাজ্জাক শাবানার অযোগ্য ছিল না। কিন্তু রাগ-জেদের বশবর্তী হয় আনোয়ার হোসেন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। একটি ভুল সিদ্ধান্ত সারাজীবনের কান্না।

তিন. অভাবে যখন পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়। তখন নীতি-আদর্শ ভুলে যায়। নিজেকে পরিস্থিতির কাছে বিনাযুদ্ধে পরাজিত করে। যেমন রাজ্জাক ব্রিফকেস ভর্তি টাকা পেয়ে, নিজের নীতি- আদর্শ ভুলে যায়। টাকাগুলো আত্মসাৎ করতে চায়।

অভাবকে যারা সৎ পথে জয় করে তারাই প্রকৃত বীর।

চার. যার স্ত্রী সৎ, সে কখনো সহজে বিপথে যেতে পারে না। যেমন রাজ্জাক শাবানার কারণে, টাকা আত্মসাৎ করতে পারে না। শাবানা রাজ্জাকের বিবেকবোধ জাগিয়ে তোলে।

পাঁচ. প্রমাণ যতই জোরালো হোক। প্রমাণ যাচাই না করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ না।

রাজ্জাক যদি জসিমের কাবিননামা, কাজি অফিসে যাচাই করতো, শাবানার বান্ধবী সুলতানার সাথে কথা বলতো। তাহলে এতো কিছু হতো না।

কিন্তু রাজ্জাক জসিমের দেওয়া কাবিননামা দেখে। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে অন্ধ হয়ে যায়। আর তাই আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলাফল ভয়ানক ছিল।

সিনেমা একটি বিনোদন মাধ্যমই না, শিক্ষার মাধ্যমও। আমরা সিনেমা থেকে বিনোদনের সাথে সাথে শিক্ষাও নিতে হবে। আর যারা সিনেমা তৈরি করেন। তারা শুধু বিনোদন দিতে গিয়ে খুল্লামখুল্লা নাচ-গান না দিয়ে, কিছু শিক্ষাও দেওয়ার চেষ্টা করুন।

কাহিনি ও কলাকুশলীদের অভিনয় দক্ষতার জন্য ‘নাজমা’ আমার প্রিয় ছায়াছবির মাঝে একটি।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

মন্তব্য করুন