Select Page

মঞ্চে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ : বেদনার অতলস্পর্শী আখ্যান

মঞ্চে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ : বেদনার অতলস্পর্শী আখ্যান

 ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকটা দেখবার পর দর্শকসারিতে অনেকক্ষণ শক্ত হয়ে বসে ছিলাম। কারণ বুকের মধ্যে যে পাথর চেপে বসেছিল সেটা আমার গোটা শরীরের ওজন বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে অবশ করে দিয়েছে। আমি নড়তে পারছিলাম না। নিঃশ্বাস নিতে চাপ অনুভব করছিলাম। কয়েক মুহূর্ত পর আলো জ্বলে উঠলো। অভিনেতা, কলাকুশলীরা ততক্ষণে মঞ্চে লাইন ধরে বো করছেন দর্শকদের। দর্শক করতালিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে মিলনায়তন। সম্বিত ফিরতেই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। করতালি দিতে দিতে অনুভব করলাম— আমি কাঁদছি।

নীলিমা ইব্রাহীমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ প্রকাশিত হয়েছিল ৯০-এর দশকের প্রথম দিকে। আমার পড়া হয়েছিল অনেক পরে। সেবার পড়তে পড়তে যে অনুভব, উপলব্ধি আর আবেগ আবিস্কার করেছিলাম এবার সৈয়দ জামিল আহমেদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এ নাটক দেখার পর নিজের মধ্যে একই রকম অনুভব, উপলব্দি ও আবেগের অনুরণনই টের পেয়েছি। তবে সে অনুরণন পূর্বের আবেগের চেয়ে আরও চাপাচাপা আরও দুর্বহ, আরও পরিণত।    

ধরুন, কেবল রুটিন করে ধর্ষণ করবার জন্য একদল নারীকে আটকে রাখা হয়েছে ক্যাম্পে, প্রায়ান্ধকার ঘরে। অপর্যাপ্ত খাদ্য-পানীয়, সীমাহীন নির্যাতন! ধরুন একজন নারী সেখানে দিনে আশিবারও ধর্ষিত হচ্ছেন। সেইসব বন্দিনীদের কেউ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেই নিশ্চিত মৃত্যু! দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অন্ধকার ঘরে মুখ বুঁজে এ বর্বরতা সহ্য করা ছাড়া তাঁদের কোন উপায় নেই। উপায় ছিল শুধু এইটুকু কল্পনা করা যে, কবে তাদের মুক্তি ঘটবে। কেউ কেউ স্বেচ্ছামৃত্যুর মধ্য দিয়েও এমন মুক্তির স্বাদ নিয়েছেন। তাঁদের মুক্তির এমন আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই নিহিত ছিল মানুষের মুক্তি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মেটাফোর।

১৯৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে এ ছিল সাধারণ চিত্র। এমন বিভীষিকাপূর্ণ বাস্তবতার পেছনে ওইসব নারীর কোন হাত ছিল না। যুদ্ধ, স্বাধীনতা, ভোট, মুক্তি- এসবের কিছুই হয়তো তাঁদের স্বার্থ-ভাবনার মধ্যেই ছিল না। একটা যুদ্ধপরিস্থিতিতে এ ভাগ্যবিড়ম্বিত নারীরা এমন অভাবনীয় সব অভিজ্ঞতা ও অভিঘাতের মধ্যে পড়েছেন যে পৃথিবীর কোনো মানুষ এমন কি এইসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না যাওয়া কোনো নারীর পক্ষেও এ নির্মমতা যথাযথ ভাষা ও অনুভব দিয়ে প্রকাশ সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বন্দি নারীদের জীবনে এমন সব ঘটনাই ঘটেছে। যা যুগে যুগে পৃথিবীর সব যুদ্ধ ও সংঘাতেও ঘটেছে। ফলে ‘যুদ্ধ ও নারী’ এ সম্পর্কিত ইতিহাসবর্তী কোন গবেষণা যদি হয় তাহলে ধরে নিতে হবে সে গবেষণা হবে মূলত সভ্যতা ও তার অস্তিত্বের নেপথ্যে অপৃথক এক জন্মদায়িনীর ত্যাগ ও তিতিক্ষার গবেষণা।

ইতিহাস পাঠ থেকে বলতে পারি, যুদ্ধ সম্পূর্ণতই একটা পুরুষতান্ত্রিক প্রবৃত্তি। যুগে যুগে দেশে দেশে যত যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছে ও হচ্ছে তার প্রধান বা নগ্নতম শিকার নারী। পুরুষতন্ত্র যেমন একদিকে নারীকে কথিত ‘ইজ্জত’-এর সিম্বল বানিয়েছে তেমনি পরাক্রম পুরুষ নারীর সে ‘ইজ্জত’ লুণ্ঠন করে প্রকাশ করেছে বিজয়, জাতি বা গোত্রদম্ভ। তো এখনো দেখা যায়, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, সিরিয়া যেখানেই যুদ্ধ ও সংঘাত সেখানেই নারী ‘লুটের মাল’। পৃথিবীর ইতিহাসে আদি থেকে অন্ত এই রীতিই বর্তমান। যে গোত্র, জাতি, দেশ, সভ্যতার জন্য নারী সর্বস্ব ত্যাগ করে সে গোত্র-জাতি-সভ্যতাই সর্বস্ব দিয়ে সেই নারীকে ঘোষণা করে ‘বিবর্জিতা’। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশেও ঘটেছে এমন ঘটনা। ‘বীরাঙ্গনা’ বলে তাদের গালভরা সম্বোধন আমরা দিয়েছি বটে তবে ধর্ম, সমাজ, সংস্কার, অন্ধতা, পুরুষতন্ত্রের উলঙ্গ আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে একটুও দ্বিধা করিনি।

মুক্তিযুদ্ধের আলাপ আসলেই আমরা একটা অতি নিম্নমানের জাতীয়তাবাদী আবেগের বিচ্ছুরণ ঘটাই। এই জাতীয়তাবাদী আবেগের গভীরে জন্ম নেয় আরেক জাতিঘৃণা। তো আবেগ ও ঘৃণার উল্লম্ফনে হারিয়ে যায় প্রকৃত ইতিহাস ও আকাঙ্ক্ষা। যেমনটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানেও সীমাহীন মাত্রায় অস্তিত্বশীল পুরুষতান্ত্রিকতা। মুক্তিযুদ্ধে শুধুমাত্র নারীর বীরত্ব প্রকাশ প্রচ্ছন্ন অর্থে তারই অংশ। বীরত্বের বাইরে যে বিশাল ও বর্ণনাতীত ক্ষেত্রটা অবহেলিত রয়ে যায় তা হলো – নারীর সেক্রিফাইস। সেটা রণাঙ্গনে যতটা তারচেয়ে বেশি রণাঙ্গনের বাইরে।

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকটা দেখে এ উপলব্ধি আবার নতুন করে জাগলো— যা দেখি, যা প্রকাশিত তার সবচেয়ে গভীর ও নিরেট সত্যটা রয়ে যায় সবচেয়ে বেশি অপ্রকাশিত। ‘দু’লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়’ শব্দবন্ধ দিয়ে যে ত্যাগটাকে একটা স্রেফ সংখ্যায় পরিণত করা হয়েছে তার আরও ব্যাপকতা ও গভীরতা অনুভব করবার জন্য ইতিহাসের পাতাল অব্দি যেতে হবে আমাদের।

নীলিমা ইব্রাহীম নিঃসন্দেহে সে পাতালে যাবার পথ দেখিয়েছেন। আর সৈয়দ জামিল আহমেদ একটা সংবেদী হৃদয় নিয়ে আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলছেন— ইতিহাসের পাতালের দিকে যাও। যাওয়ার আগে মাথা নত করে যাও। কারণ সেখানে গিয়ে যা দেখবে এর পর তো মাথাই থাকবে না।

শ্রদ্ধাবণত প্রণাম সৈয়দ জামিল আহমেদ। আপনার চিন্তা ও তৎপরতার কাছে রেখে যাই এক একনিষ্ঠ ভক্তের অন্তঃশীল ভালবাসা। স্পর্ধা রেপার্টরি নাট্যদলের প্রত্যেক অভিনেতা, কলাকুশলীকে আমার সংবেদী আত্মার শুভবাদ যে, এমন কষ্টসাধ্য ও অনন্য প্রযোজনা নির্মাণে নিজেদের শ্রম ব্যয়ে ব্রতী হয়েছেন। নাটকের আরও খুঁটিনাটি নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত কথা হবে হয়তো অন্য কোথাও। আজ এইটুকু বলে রাখি, যে দম ও গতি নিয়ে নাটকটা উপস্থাপনে সমর্থ হয়েছেন সে দম ধরে রাখবেন স্ব স্ব দলে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে।

দর্শকদের বলব, গুরুত্বপূর্ণ এ নাটকটা দেখতে ভুলবেন না। ইতিহাসে এমন কাজ খুব কমই হয়। শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে আজ থেকে শুরু হয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত প্রদর্শিত হবে এ নাটক।

ছবি: সংগৃহীত


About The Author

রহমান মুফিজ

কবি, লেখক ও সাংবাদিক

Leave a reply