Select Page

ম্যানলি হিরো আলমগীর

ম্যানলি হিরো আলমগীর

প্রায় ছয় ফুট লম্বা সুদর্শন স্টাইলিস্ট ২৩ বছরের এক যুবকের আগমন ঘটে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রে। ম্যানলি ইমেজ ও পরিপূর্ণ অভিনয় গুনে সব শ্রেণির দর্শকদের নজর কেড়েছিলেন তিনি।

সামাজিক, অ্যাকশন, ফোক, পোশাকি, লোক কাহিনি, সাহিত্যনির্ভর সব ধরনের ছবিতেই যিনি অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি আলমগীর, পুরো নাম মহিউদ্দিন আহমেদ আলমগীর। গুণী পরিচালক জনাব আলমগীর কুমকুমের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘আমার জন্মভূমি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম আসেন রূপালি পর্দায় আসেন, সেটা ১৯৭৩ সালের কথা। তবে ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল তার, বাবা কলিম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ব্যবসায়ী ও সংস্কৃতিমনা মানুষ, এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর জন্য তিনি অর্থও প্রদান করেন৷

‘আমার জন্মভূমি’ (২৪/১০/৭৩) ছবিতে অন্যতম একটি চরিত্রে অভিনয় করলেও আলমগীরকে অভিনয়ের পরীক্ষা দিতে হয়েছে সে সময়ের জনপ্রিয় তারকা রাজ্জাক, কবরী, মাহফুজ, রাজু আহমেদদের সঙ্গে। এতসব তারকা অভিনেতাদের সঙ্গে তরুণ আলমগীর অভিনয় দক্ষতায় উতরে গেছেন। প্রশংসিত আলমগীর ছবিটির শুটিং চলাকালীন আরও পাঁচটি চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হন, সেই শুরু আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যার ফলস্বরূপ তিনি অর্জন করেছিলেন সর্বোচ্চ নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, যা এখনো একজন অভিনেতা হিসেবে রেকর্ড, পেয়েছেন আজীবন সম্মাননাও।

‘ভাত দে’ সিনেমায় শাবানা-আলমগীর

অভিনেতার পাশাপাশি আলমগীর প্রযোজক-গায়ক এবং সফল চিত্র পরিচালক। ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বৌমা’ ছবিটির পরিচালনার মাধ্যমে তার নির্মাণের দক্ষতার পরিচয় দেন, এরপর ১৯৮৬ সালে ‘নিষ্পাপ’, ছবিটি সে বছর ব্যবসায়িকভাবে দারুণ সফলতা পায়, পরবর্তীতে তিনি আরও দুটিসহ মোট চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং প্রশংসা কুড়ান। তার নির্মিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘একটি সিনেমার গল্প’ সে বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বেশ কয়েকটি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। এর মাঝে ১৯৯৬ সালে নির্মিত ‘নির্মম’ও দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছিল, ছবিটিতে অসাধারণ অভিনয়ের গুনে শাবনাজ প্রথমবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

আলমগীর অভিনয় ও পরিচালনার পাশাপাশি কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠও দিয়েছেন যা অনেকেরই অজানা। ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আলমগীর কুমকুমের পরিচালনায় ‘আগুনের আলো’ ছবিতে তিনি প্রথম কণ্ঠ দেন, এরপর ফখরুল হাসান বৈরাগীর ‘কার পাপে’ (০৫/০১/৭৯), আলমগীর কুমকুমের ‘ঝুমকা’ (০৩/০৪/৮১)-সহ আরও দু-তিনটা ছবিতে কণ্ঠ দেন তিনি।

আলমগীরের চলচ্চিত্রের যাত্রা সত্তর দশকে শুরু হলেও তার মূল রাজত্ব শুরু হয় আশির দশক থেকে; যা একেবারে নব্বই দশকের শেষ অবধি পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। এই দুই দশকে তিনি ১৬৮টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। মজার ব্যাপার হলো, এই ১৬৮টি চলচ্চিত্রের মধ্যে এক শাবানার সঙ্গেই তিনি জুটি হয়ে করেছেন প্রায় ৭৫টির মতো চলচ্চিত্র, যা আরেকটি রেকর্ড। আমার যদি ভুল না হয় তাহলে পৃথিবীর আর কোথাও এত সংখ্যক ছবিতে জুটি হয়ে অভিনয় করার কোন রেকর্ড নেই।

শাবানার কথাই যখন আসলো তখন বলতে হয় আলমগীরের ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় ছবিটিই ছিল শাবানার সঙ্গে সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া পরিচালিত ‘দস্যুরানী’ (২৮/১০/৭৩)। এরপর আরও দুটি ছবি  ‘অতিথি’ (১৪/১২/৭৩) ও ‘চাষীর মেয়ে’ (২০/০৬/৭৫)-তে তাদের দেখা গেছে। সেই শুরু যার শেষটা ২০০১ সালে আজিজুর রহমানের ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ছবির মাধ্যমে, এটি শাবানার শেষ ছবি। আর এর মাঝে করা তাদের চলচ্চিত্রে সাফল্যের পাল্লাটাই ছিল ভারী।

ববিতার সঙ্গে আলমগীর

শুরুর দিকে ববিতার সঙ্গে (জাল থেকে জ্বালা, মেহের বানু, হারানো মানিক, চম্পা চামেলী, আপন ভাই, দিওয়ানা, প্রতিজ্ঞা, কসাই, ঝুমকা, নবাবজাদী, মানে না মানা, নির্দোষ) জুটি গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে তা শাবানার সঙ্গে স্থায়ী হয়। মূলত শাবানার সঙ্গে আলমগীরের জুটি গড়ে উঠে মধ্য আশির দশকের পর থেকে যার পূর্ণতা আসে নব্বই দশকে। এ দশকে আলমগীরের প্রায় সব ছবিতেই দেখা গেছে শাবানাকে, বিশেষ করে এ জে মিন্টুর ‘বিশ্বাসঘাতক’ (১৯/০৫/৮৮), ‘সত্য মিথ্যা’ (০৩/০৩/৮৯), কামাল আহমেদের ‘ব্যথার দান’ (৩১/০৩/৮৯), মতিন রহমানের ‘রাঙাভাবী’ (০৭/০৫/৮৯) ছবিগুলোর কথা বলতে হয়। অসামান্য সাফল্য ও দর্শকদের ভালো লাগার প্রেক্ষিতে পুরো নব্বই দশকটাই আলমগীরের সঙ্গে শাবনাকেই জুটি করে নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং সফল হয়েছেন। শুধু শাবানা-ববিতা নন আলমগীর জুটি হয়ে অভিনয় করেছেন সুচরিতা, রোজিনা, নূতন, অঞ্জু ঘোষ, কবরীদের মতো তারকা অভিনেত্রীদের সঙ্গে।

আলমগীর তার দীর্ঘ চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে অসামান্য অভিনয়ে পেয়েছেন নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার; যার মধ্যে সাতবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও দুবার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কামাল আহমেদের পরিচালনায় ‘মা ও ছেলে’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ে পান প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ছবিটিতে তার সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন শাবানা ও বুলবুল আহমেদ। দ্বিতীয় পুরস্কার আসে ১৯৮৭ সালে দিলীপ বিশ্বাসের পরিচালনায় ‘অপেক্ষা’র মাধ্যমে, সহশিল্পী ছিলেন শাবানা, জাফর ইকবাল ও সুচরিতা, পরবর্তীতে মালেক আফসারীর ‘ক্ষতিপূরণ’ (১৯৮৯), আজহারুল ইসলামের ‘মরণের পরে’ (১৯৯০), এ জে মিন্টুর ‘পিতা মাতা সন্তান’ (১৯৯১) ও মতিন রহমানের ‘অন্ধবিশ্বাস‌‌’ (১৯৯২) চলচ্চিত্রের জন্য টানা চারবার আলমগীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। যা আরেকটি রেকর্ড।

রোজিনার সঙ্গে আলমগীর

জাতীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কারের তালিকা— শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ‘মা ও ছেলে’ (১৯৮৫), ‘অপেক্ষা’ (১৯৮৭), ‘ক্ষতিপূরণ’ (১৯৮৯), ‘মরণের পরে’ (১৯৯০), ‘পিতা মাতা সন্তান’ (১৯৯১), ‘অন্ধবিশ্বাস‌‌’ (১৯৯২), ‘দেশপ্রেমিক’ (১৯৯৪), শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে ‘জীবন মরণের সাথী’ (২০১০) ও ‘কে আপন কে পর’ (২০১১)।

আলমগীর অভিনীত উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে— আমার জন্মভূমি, অতিথি, লাভ ইন সিমলা, মনিহার, মধুমিতা, জিঞ্জির, মাটির মানুষ, আপন ভাই, প্রতিজ্ঞা, কসাই, ঝুমকা, ওস্তাদ শাগরেদ, মধু মালতী, বড় বাড়ীর মেয়ে, সবুজ সাথী, কেউ কারো নয়, রজনীগন্ধা, মান সম্মান, গলি থেকে রাজপথ, ধন দৌলত, স্বামীর ঘর, সকাল সন্ধ্যা, সখিনার যুদ্ধ, ভাত দে, অন্যায়, গীত, মা ও ছেলে, ন্যায় অন্যায়, আওলাদ, অশান্তি, তালুকদার, মাটির কোলে, নিষ্পাপ, ভরসা, স্বামী স্ত্রী, বিশ্বাসঘাতক, সত্যমিথ্যা, রাঙাভাবী, ক্ষতিপূরণ, ছেলে কার, চেতনা, লাখে একটা, দোলনা, মরণের পরে, পিতা মাতা সন্তান, অচেনা, সান্ত্বনা, অন্ধ বিশ্বাস, ক্ষমা, ঘরের সুখ, সত্যবাদী, বাংলার বধূ, জজ ব্যারিস্টার, দেশ প্রেমিক, ঘাতক, সংসারের সুখ দুঃখ, তপস্যা, রাক্ষস, দুর্জয়, অর্জন, মায়ের অধিকার ও বাপের টাকা।

আলমগীর জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ৩_এপ্রিল ঢাকায়। পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবী নগরে হলেও তার বেড়ে ওঠা ঢাকাতে। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৩ সালে আলমগীর খোশনূরকে বিয়ে করেন। খোশনূর গীতিকার হিসেবে বেশ পরিচিতি ছিলেন, বাংলা চলচ্চিত্রের বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি। তাদের দুই মেয়ের একজন আঁখি আলমগীর গায়িকা হিসেবে বেশ পরিচিত। ১৯৯৯ সালে খোশনূরের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর আলমগীর দেশবরেণ্য গায়িকা রুনা লায়লাকে বিয়ে করেন।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আরিফুল হাসান

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন