Select Page

‘রাজবাড়ী’র রিভিউ/ হানাবাড়ী হলেই বা আপত্তি কী?

‘রাজবাড়ী’র রিভিউ/ হানাবাড়ী হলেই বা আপত্তি কী?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প অবলম্বনে কাজী হায়াৎ নির্মাণ করেছিলেন ভৌতিক ধারার চলচ্চিত্র ‘রাজবাড়ী’। মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। অভিনয় করেন সোহেল রানা ও অঞ্জনা। সাপ্তাহিক বিচিত্রার এপ্রিল ১৯৮৪ সংখ্যায় সিনেমাটির রিভিউ করেন মাহমুদা চৌধুরী। বিএমডিবির পাঠকদের জন্য সেই রিভিউটি তুলে ধরা হলো।

কাজী হায়াৎ এবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‌‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ভেঙ্গে যে আবে হায়াতের সন্ধান দিলেন, তাহলো ‘রাজবাড়ী’। হানাবাড়ী হলেই বা আপত্তির কী? আসলে পরিচালকের লক্ষ্য ছিল— ফ্যান্টাসির সুবিধাযুক্ত একটি পোশাকি ছবি তৈরি করার দিকে।

ফলে গল্পের মূল ভিতটাই নড়ে গেছে। অযোগ্য স্বামীর হাতে চেনা-জানা কোনো রূপবতী মেয়ের লাঞ্ছনা দেখলে যেমন মনঃকষ্ট হয়— ঠিক তেমনি যাতনা ভোগ করতে হয়েছে ক্ষুধিত পাষাণের অকল্পনীয় দুর্দশা দেখে। অথচ ছোটগল্প নিয়ে ছবি তৈরি করার কত সুবিধা— ডিটেলস ও ছোট ছোট ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়ে— ফাঁকফোঁকরগুলো ইচ্ছেমত পূরণ করা যায়।

গলদ প্রথম শট থেকেই টের পাওয়া গেল। ক্যামেরা গরু থেকে প্যান করে গাড়ির উপর জুমআপ না হয়ে-গাড়ি থেকে গরুতে যাওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। তাতে প্রতীকের অন্ত্যস্থ ব্যঞ্জনা স্পষ্ট হতো। যন্ত্রযুগের যুক্তিবোধ বিসর্জন দিয়ে আদিকালে প্রত্যাবর্তনের মানসিক প্রস্তুতি সত্তর গ্রহণ করা দর্শকের পক্ষে সহজতর হতো।

আধুনিক দম্পতি যুগল— শহর থেকে মাত্র ৩৮ মাইল দূরে বেড়াতে গিয়ে বিপাকে পড়ে, এসে উপস্থিত হলো এক হানাবাড়িতে। সেখানে যাত্রার প্রিন্সেসদের মতো সাজা দেয়া এক তরুণীর সঙ্গে আধুনিক পোশাক পরা ব্যাটাছেলের ফ্যান্টাসির রঙ্গলীলা দেখে— তারা ভিমরি খেলো। কদলীবাগানের মধ্য দিয়ে পালাতে গিয়ে দর্শন পেল ‘সব ঝাট হ্যায়’ বলা মেহের পাগলার। সব রহস্যের ভেদ করে দিল— সেই পাগলাই। খুব বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র এক যুগ অর্থাৎ‍ বারো বছর আগে, স্থানীয় কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হয়ে যে শিক্ষকটি এলো, তার বাতিক ছিল ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য বস্তু সংগ্রহের। ছবিতে যাত্রায় ব্যবহৃত মুকুট আর টিনের তালোয়ার দেখিয়েই পরিচালক বাজিমাত করার চেষ্টা করলেন। এবং কলেজ লাগোয়া হোটেলে অনেকের বাস থাকলেও প্রথম সন্ধ্যার বাতি জ্বালার ক্ষণ থেকেই শিক্ষকের ওপর ভর করতে লাগল ‘সূর্যকন্যা’ ছবির আধারে বন্দিনী লাবণ্যের মতো এক ছায়ানারী। ইনিও কায়া ধরতে জানেন। ফিসফিসিয়ে নয় স্পষ্ট গলায় গান গান জাভেদীয় ভঙ্গীতে কাঁধ বুক ঝাঁকিয়ে নৃত্য দেখান, নিশি রাতে দেখা স্বপ্ন বাস্তবেও সত্যি হয়ে উঠল-কলেজের সবচেয়ে ফ্যাশন-দুরস্ত ছাত্রী আলেয়া চৌধুরীর সঙ্গে নিশিকন্যার আশ্চর্য সাদৃশ্যে লক্ষ্য করে অধ্যাপক হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে ক্লাস ছেড়ে পালাল। আর মেয়েটি এটাকেই স্যারের অনুরাগ মনে করল, কিন্তু, পরে ঘাটের নির্জনে প্রেমের অনিবার্য সংলাপের পরিবর্তে প্রেমস্পদের মুখে—‘সেই চোখ’ ‘সেই মুখ’… আচ্ছা তুমি কি রাজবাড়ির বাইজী ছিলে? প্রশ্ন শুনে হতাশ আলেয়া পালিয়ে বাঁচে, তাই বলে একেবারে হাল ছাড়ে না। দিবানিশির প্রেমের খেলায় জয় হল নৃত্য-গীতে পারদর্শী সালঙ্কারা নিশিকন্যারই।

হলিউডের সায়েন্স ফিকশনগুলোর মতো এই অধ্যাপকও একদিন চলে গেল অতীতকালে। আরব্য রজনীর ‘জেলে ও জীনের’ গল্পের আদলে কফিন থেকে মুক্ত হওয়া রাজা সূর্য কুমারের সঙ্গে বিস্তর বাক্য বিনিময় হল, অ্যাটম বোমা প্রসঙ্গ বাদ গেল না। অবশেষে মুক্তিদাতার প্রাণ সংহারের সংকল্প নেয়া হলে, পোশাকী ছবির অবধারিত অসি যুদ্ধ বাঁধল। নিশিকন্যার সেই যুদ্ধে মরণ হলে অধ্যাপকের পুনরায় বস্তুলোকে প্রত্যাবর্তন ঘটল। এখানেও তার রেহাই নেই ছাত্রী আলেয়াকে জড়িয়ে রটানো কলঙ্কের বৃক্ষে ততদিন ফলধরা শুরু হয়ে গেছে। নিষ্কৃতি মিলল পদত্যাগ করে।

বিদায়লগ্নে জেনেটিকসের সূত্রানুসারে দুই কন্যার হবহু সাদৃশ্যের জট ছাড়ান হলো। আলেয়াদের বংশেরই মেয়ে ছিল সেই নিশিকন্যা। রাজা সূর্য কুমার তাকে অপহরণ করে নর্তকী বানিয়েছিল। শেষাবধি, আলেয়া আর অধ্যাপকের মিলন যখন অনিবার্য— চিত্রনাট্যকার-পরিচালকের হস্তক্ষেপে তারা হয়ে যায় শিরি-ফরহাদ, লাইলী-মজনু।

এই অবিন্যস্ত-বেসামাল কাহিনির বিভিন্ন চরিত্রে সোহেল রানা, তারেক, আফগানী, সুলতানা, অঞ্জনা— মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন। তবে গানগুলো ছিল সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক। বেসুরো গলায় ‌‘প্রিয়তম তুমি আমার প্রিয়তম’ গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘অফ যা’ বলে ফ্ন্ট স্টল থেকে প্রবল আপত্তি উঠেছে।

এছাড়া কাহিনি বিন্যাসে মাত্রাবোধহীনতা ছিল চূড়ান্ত। একটি মফস্বলের কলেজের শিক্ষক-ছাত্রদের শানদার স্যুট-বুটের সুবেশ কতখানি বিশ্বাসযোগ্য? যাই হোক, একটা কথা আমাদের মালুম হলো; রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তা দাঁড়ায়, ‘লোকটা আমাদের বোকার মত দেখিয়া কৌতুক করিয়া ঠকাইয়া গেল …’

*মূল লেখাটি ছিল শিরোনামiহীন। এছাড়া বানানরীতি পরিবর্তিত।


মন্তব্য করুন