Select Page

রাজীব : এক বাঘের গল্প

রাজীব : এক বাঘের গল্প

আমাদের বাপ-চাচারা অভিনেতা রাজীকে বলতেন ‘বাঘ’। সত্যিই তিনি বাঘের মতো গর্জন করতেন পর্দায়। তাঁর কণ্ঠে খলনায়কের বিভৎসতা যেমন প্রাণ পেত তেমনি সাদামাটা চরিত্রও দর্শকের মন জয় করত। একজন আপাদমস্তক অভিনেতা তিনি। তাঁর বৈশিষ্ট্যই ছিল বাঘের মতো বলিষ্ঠতা। পর্দায় যতক্ষণ থাকতেন চরিত্রকে শাসন করতেন।

পর্দা নাম রাজীব। মূলনাম ওয়াসিমুল বারী রাজীব। জন্ম ভাষা আনদোলনের বছরে ১৯৫২ সালে। তারিখ ১ জানুয়ারি। পটুয়াখালী জেলার দুমকিতে।

ব্যক্তিজীবনে চলচ্চিত্রজগতে আসার আগে চাকরি করতেন তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে ১৯৯৬ সালে বন্যা দুর্গত মানুষদের দেখতে যাবার পথে পানিতে ডুবে মারা যায়। দীপ্ত নামে আরেকটি ছেলে আছে।

পড়াশোনা করেছেন গ্যাস টেকনোলজি বিষয়ে। বেতার, মঞ্চ ও টিভি অভিনেতা ছিলেন। এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। রাজৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সমর্থক ছিলেন। জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্র পরিষদের সভাপতি হিশেবেও তাঁকে দেখা গেছে।

ঢালিউডে নায়ক হয়ে আসেন ১৯৮১ সালে ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ ছবিতে। নায়ক হয়ে তারকাখ্যাতি পান কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘খোকনসোনা’ ছবিতে। এছাড়া ‘দাবি’ নামের আরেকটি ছবিতে নায়ক ছিলেন। একসময় কাজী হায়াতের ছবির রেগুলার আর্টিস্ট ছিলেন এবং স্মরণীয় চরিত্র করেছেন তাঁর ছবিতে।

চলচ্চিত্র প্রযোজনাতেও তাঁকে দেখা গেছে। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ফ্রেন্ডস মুভিজ।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি – বিদ্রোহী, পরাণপাখি, জীবনধারা, ভাত দে, মানিক রতন, সম্রাট, শক্তি, মায়ের দাবি, যন্ত্রণা, রাজভিখারি, নকল শাহজাদা, বেরহম, মিয়াভাই, হিসাবনিকাশ, আন্দাজ, অহিংসা, পুষ্পমালা, জারকা, নবাব, সাহেব, খামোশ, উসিলা, দাগী, কাবিন, আওয়াজ, আয়নামতি, চাচা ভাতিজা, চন্দনা ডাকু, অবিশ্বাস, নিয়ত, হীরামতি, চাঁদাবাজ, দাঙ্গা, বিদ্রোহ চারিদিকে, রক্তের বদলা, দেশদ্রোহী, মীরজাফর, হিংসার আগুন, শেষ সংগ্রাম, শেষ খেলা, বুকের ভিতর আগুন, সত্যের মৃত্যু নেই, প্রেম দিওয়ানা, অপরাজিত নায়ক, জিদ্দি, ডন, বাবার আদেশ, স্নেহের প্রতিদান, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, দেনমোহর, প্রেম পিয়াসী, স্বপ্নের ঠিকানা, স্বপ্নের পৃথিবী, অন্তরে অন্তরে, বিক্ষোভ, মহামিলন, বিদ্রোহী আসামী, সত্য মিথ্যা, হুমকি, বীরাঙ্গনা সখিনা, মা মাটি দেশ, প্রেম প্রতিজ্ঞা, টাকার অহংকার, শয়তান মানুষ, দুর্নীতিবাজ, মিথ্যার রাজা, আজকের প্রতিবাদ, একজন বিদ্রোহী, প্রিয় তুমি, বিদ্রোহী কন্যা, বিদ্রোহী সন্তান, লক্ষীর সংসার, প্রেম বিরহ, শেষ রক্ষা, ঘায়েল, হাঙর নদী গ্রেনেড, বন্ধন, জবরদখল, আখেরি রাস্তা, চালবাজ, বিদ্রোহী প্রেমিক, বীরযোদ্ধা, ওমর আকবর, ছলনা, দিনকাল, লজ্জা, বাঘিনী কন্যা, মাতৃভূমি, প্রেম যমুনা, শেষ পরিচয়, আদেশ, শেষ যুদ্ধ, মহান বন্ধু, ডিস্কো ড্যান্সার, আত্মরক্ষা, সন্ধান, জিদ, লাভ, ডন, আজকের সন্ত্রাসী, দুর্জয়, ত্রাস, ক্ষমা, লুটতরাজ, দেমাগ, দেশ দরদী, অন্ধ বিশ্বাস, সত্য মিথ্যার লড়াই, মহা সংগ্রাম, মৃত্যুদাতা, আর্তনাদ, নয়ন ভরা জল, মেয়ের অধিকার, মিস ডায়না, গোলাপি এখন ঢাকায়, অন্ধ ভালোবাসা, বেপরোয়া, ভয়ঙ্কর সাতদিন, চোরের বউ, চাকর, স্ত্রীর পাওনা, ন্যায়যুদ্ধ, রাজার মেয়ে বেদেনী, আপন পর, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, যোগাযোগ, জাদুমহল, আদিল, স্বামী-স্ত্রী, চাঁদের আলো, মহৎ, বিসর্জন, আত্মত্যাগ, আজকের হাঙ্গামা, খলনায়ক, যোদ্ধা, ভণ্ড, বিপ্লবী জনতা, মগের মুল্লুক, গুণ্ডার প্রেম, বিশ্ব বাটপার, জুম্মন কসাই, আব্বাজান, বলো না ভালোবাসি, গুণ্ডার প্রেম, বিশ্ব বাটপার, মেঘের পরে মেঘ, মেঘলা আকাশ, অন্যমানুষ, ও প্রিয়া তুমি কোথায়, বলো না ভালোবাসি, হৃদয়ের বন্ধন, প্রেমের তাজমহল, আগুন জ্বলবেই, ভালোবাসা কারে কয়, ভালোবাসি তোমাকে, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ভাইয়া, বাঘের বাচ্চা, খতম, পড়ে না চোখের পলক, ভালোবাসার দুশমন, মায়ের সম্মান, স্বপ্নের বাসর, স্বপ্নের পুরুষ, জামাই শ্বশুর ইত্যাদি।

চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার ভূমিকায়। ছবিগুলো হলো – হীরামতি (১৯৮৮), দাঙ্গা (১৯৯১), বিদ্রোহ চারিদিকে (২০০০), সাহসী মানুষ চাই (২০০৩)। এছাড়া চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পুরস্কার পেয়েছেন।

রাজীবের অভিনয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর কণ্ঠ। কণ্ঠের দরাজ অভিব্যক্তি দর্শককে মুগ্ধ করত। দরাজ কণ্ঠে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত, দেনমোহর’ ছবিগুলোতে আহমেদ শরীফের সাথে রাজিবের অভিনয়ের অংশগুলো স্মরণ করলেই বোঝা যাবে। ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবিতে অমর নায়ক সালমান শাহর সাথে রাজা-প্রজার জবাবদিহির সময় খোলা মাঠের তর্কের সিকোয়েন্সটি মনে করলেও বোঝা যায় তাঁর ভরাট কণ্ঠের জাদু।

রাজীব বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি খলনায়ক। বাঘের মতো গর্জন তুলে পর্দায় অভিনয় করতেন। খলনায়কের ভূমিকায় তাঁর ছবিগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – দাঙ্গা, চাঁদাবাজ, হীরামতি, ভাত দে, ত্রাস, লুটতরাজ, জবরদখল, মীরজাফর, মিথ্যার রাজা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, স্বপ্নের পৃথিবী, বিক্ষোভ, বিদ্রোহী সন্তান, ক্ষমা, শেষ সংগ্রাম, শেষ খেলা। ‘দাঙ্গা’ ছবিতে তাঁর ভয়ঙ্কর অভিনয় ছিল। আশীষ কুমার লোহের চোখ তুলে নেয়া, জিহবা কেটে ফেলা এবং মান্নার হাত কেটে নেয়ার অভিনয় যে কাউকে ভয় পাইয়ে দেবে। ‘চাঁদাবাজ’ ছবিতে চাঁদা চাওয়া এবং ডেট ওভার হলে খুন করা তাঁর পেশা। ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মানুষ মারতেন। ‘ভাত দে’ ছবিতে নারীলোভীর চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন পাশাপাশি পুঁজিবাদী মজুতদারের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। ভণ্ড নেতার ভূমিকায় ‘বিক্ষোভ, ত্রাস, আজকের প্রতিবাদ’ এবং রাজাকারের ভূমিকায় ‘মীরজাফর’-এ অসাধারণ। ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিতে মীরজাফরের পুত্র মীরনের ভূমিকায় স্মরণীয় কাজ ছিল তাঁর। তাঁর আদেশেই নবাবকে হত্যা করা হয়। ‘ক্ষমা, শেষ খেলা’ ছবিগুলোতে রাজিবই ছবিকে নায়কের থেকে বেশি টেনে নিয়েছেন। ‘শেষ সংগ্রাম’ ছবিতে তাঁর লুক ছিল স্টাইলিশ। ভয়ঙ্কর এক যন্ত্র দিয়ে মানুষ জবাই দিতেন। তাঁর নামেই ছবির নামকরণ হত প্রধান চরিত্রের শক্তিতে যেমন – মীরজাফর, চাঁদাবাজ। খলনায়কের ভূমিকার পাশাপাশি তিনি কমেডিও করতেন যেমন – মীরজাফর।

পজেটিভ চরিত্রেও রাজীবের দখল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাবা, ভাই, বন্ধু, দরিদ্র এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পজেটিভ চরিত্রের ছবির মধ্যে আছে – বিদ্রোহ চারিদিকে, অন্তরে অন্তরে, জিদ্দি, অপরাজিত নায়ক, অন্ধ ভালোবাসা, স্নেহের প্রতিদান, ঘায়েল, প্রেম পিয়াসী, অন্যমানুষ ইত্যাদি।

‘বিদ্রোহ চারিদিকে’ ছবিতে তিনি একটা চেতনা ছিলেন। পপিকে তাঁর নির্যাতিত জীবন থেকে প্রতিবাদী ভূমিকায় আনতে নামকরা চরিত্র ‘কদম রসুল’-এর ভূমিকায় ছিলেন। এন্ট্রি সিনে বড় লাঠি হাতে পপিকে ডাকার অভিনয় মাইন্ডব্লোয়িং। ‘অন্তরে অন্তরে’ ছবির রাজিব গরিব জেলের চরিত্রে মিশে যান। ‘স্নেহের প্রতিদান’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের ভাইয়ের চরিত্রে অসাধারণ ছিলেন এবং ছবির অন্যতম প্রধান ভূমিকায় ছিলেন। ‘অন্যমানুষ’ ছবিতে কাজী মারুফের ফাদার চরিত্রে অসাধারণ ছিলেন। পজেটিভ-নেগেটিভের মিশেলে ছিলেন ‘আত্মরক্ষা, বুকের ভিতর আগুন, ভালোবাসা কারে কয়’ ছবিগুলোতে। ট্র্যাজেডির গল্পে নায়ক ছিলেন ‘খোকনসোনা’ ছবিতে। ছবিটিতে শিশুশিল্পী ছিল কাজী মারুফ।

সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। যেমন – মেঘের পরে মেঘ, বিরাজ বউ, হাঙর নদী গ্রেনেড। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস থেকে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ছবিতে তাঁকে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তরুণদের উৎসাহ দিতে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে শোনেন। পরে রাজাকার নাসির খানের চক্রান্তে তাঁকে ধরা পড়তে হয়। রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস ‘ফেরারী সূর্য’ থেকে নির্মিত ‘মেঘের পরে মেঘ’ ছবিতেও রিয়াজের পরিণতি ঘটাতে রাজিব ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ।

রাজীবের অনেক ছবিতে অনেক জনপ্রিয় সংলাপ আছে। তাঁর মধ্যে কিছু সংলাপ –

আমি মাইন্ড করলাম – দাঙ্গা
ইল বাবা – চাঁদাবাজ
রাজনীতিতে একটা কথা আছে – বিক্ষোভ
শান্তি নাইরে শান্তি নাই – মীরজাফর
ঐ আমার চেহারা মাপ আমি আরজুর বাপ – আসামী গ্রেফতার
ইলু ইলু – শেষ সংগ্রাম
কী আনন্দ কী আনন্দ – হিংসার আগুন
আমি এল এল বি লাইফ লং ব্যাচেলর – বিদ্রোহী সন্তান
আগুন নিয়ে খেলতে আমি ভালোবাসি – লক্ষীর সংসার
আপনি পচা – খলনায়ক
আমি ছিলাম আমি আছি আমি থাকব – মিথ্যার রাজা
কী আশচাইযো – ত্রাস

রাজীবের ছবিতে তাঁর ইন্ট্রোতে কিছু গান ছিল। গানে তাঁর প্রাধান্য থাকত সেসব ছবিতে। কয়েকটি উদাহরণ :

মোরা নিরন্ন বড় ক্ষুধার্ত – বিদ্রোহ চারিদিকে
সুন্দর সন্ধ্যায় এ গান দিলাম উপহার – শেষ খেলা
বাবা বলে ছেলে নাম করবে – কেয়ামত থেকে কেয়ামত
তোমার মরণকালে কাঁদবে যে জন – আব্বাজান
তোর লাল গোলাপি গাল – হুলিয়া
এই দিন সেই দিন এলো ফিরে – স্নেহের প্রতিদান
খুলো না ঢাকনা – আত্মত্যাগ
কি জানি কি হয় – দায়িত্ব

দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগার পর ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর অভিনেতা রাজীব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৫২ বছর।

কিংবদন্তি অভিনেতা রাজীব টোটাল প্যাকেজ অভিনেতা। তিনি তাঁর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে ভেরিয়েশন রেখে নায়ক-খলনায়ক-পজেটিভ-কমেডি-ট্র্যাজেডি এভাবে একজন চরিত্রাভিনেতা হয়ে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। আগামী প্রজন্মর কাছে তিনি অভিনয়ের প্রতিষ্ঠান এবং তাঁকে আদর্শ ভেবে অভিনয়ের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে।

কয়েকটি তথ্যের ঋণস্বীকার – ড. অনুপম হায়াৎ


মন্তব্য করুন