Select Page

রূপসী বাংলার এক ‘রাত জাগা ফুল’

রূপসী বাংলার এক ‘রাত জাগা ফুল’

‘আমরা যখন ঘুমাই রাতে প্রকৃতি জেগে থাকে। রাতের অনেক গল্প থাকে আনন্দের, আতঙ্কের আরো অনেক গল্প। আর ফুল সারাজীবন ধরে ফুটে যায় আমরা কেউ জানি না সে কখন ফোটে। ‘রাত জাগা ফুল’ সেই ফুল ফোটার গল্প, তার কি ভূমিকা ছবিতে সেটা নিহিত আছে।’

কুকুরের অভিনয় কি দেখেছেন?
পেঁচার অভিনয় কি দেখেছেন?
অবলা জীব বা পাখি কি মানুষের থেকে ভালো অভিনয় করতে পারে! তাদেরকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন মীর সাব্বির। মানুষের থেকে প্রকৃতি ও প্রাণিদের মানবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন ‘রাত জাগা ফুল’ ছবিতে। রূপসী বাংলার এক রাত জাগা ফুল বছর শেষে ভালো ছবির উপহার যেন।

একজন অভিনেতার নির্মাতা পরিচয়ের প্রথম ছবি যখন আপনি দেখবেন মানসিকভাবে প্রস্তুতি বোধ করবেন কেমন হবে ছবিটি। ছবি কেমন হওয়ার বিষয়টি যদিও যে কোনো নির্মাতার জন্য প্রযোজ্য কিন্তু অভিনেতার আগাম পরিচয় এবং মীর সাব্বিরের মতো জনপ্রিয় অভিনেতার প্রথম ছবির ক্ষেত্রে আগ্রহটা বাড়তিভাবেই থাকার কথা। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার পর ‘রাত জাগা ফুল’ দর্শন আপনার কাছে যখন একজন নতুন সম্ভাবনাময় নির্মাতার ছবি হয়ে উঠবে সেটা বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। হ্যাঁ, ‘রাত জাগা ফুল’ শুধু মানসম্মত ছবি হয়েছে তা নয় বরং একজন নতুন মীর সাব্বিরকে দর্শকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

ডিজিটাল সময়ের ছবিতে শহুরে ছবির প্রচলন বেশি বেড়েছে, গ্রাম-বাংলার ছবি কমে গিয়েছে। মীর সাব্বির গ্রাম-শহর সহযোগে একটি পরিপূর্ণ বিনোদনধর্মী ছবি নির্মাণ করেছেন। গ্রামের গল্পটি শহরের সাথে সাঁকো তৈরি করেছে পরিণতির দিকে এগিয়েছে।

মীর সাব্বির জঙ্গলে বড় হয়েছে। পশুপাখি, গাছের সাথে সে কথা বলে, তাদের ভাষা বোঝে আর সমাজ প্রচলিত নিয়মে তাকে ‘পাগল’ বলে। কিন্তু পাগল আসলে কে? যে কারো ক্ষতি করে না নাকি যে ক্ষতি করে বেড়ায় সে? হঠাৎ একটা ছেলে মারা যায় গ্রামে তারপর কিছু পরিবর্তন ঘটে। রইস পাগলা বা মীর সাব্বির তার পোষা প্রিয় কুকুরের ভাষায় একটা আভাস পায় তারপর কী হতে যাচ্ছে? রইস পাগলা এক রাত জাগা ফুল যে দার্শনিক কথাবার্তা বলে এবং গল্পে দুই ধরনের বাঁক আসতে থাকে।

ছবির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে প্রকৃতি এবং প্রাণিকে মানুষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে দেখানো হয়েছে। যেমন মীর সাব্বিরের মুখে সংলাপ আসে-‘ঘরের একটা পিঁপড়াও সব দ্যাখে কিন্তু বলতে পারে না।’ যে যাই করুক যদি সেটি খারাপ কিছু হয় তবে তার ফল ভোগ করতেই হবে এবং প্রকৃতির বিচারই সেটা যেখানে কুকুর, পেঁচা, বানর এরা হচ্ছে নির্বাক কথক। মীর সাব্বির অবলা জীবকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন। কুকুরের অভিনয়ের বিশেষ একটি সময় অবাক করে দেবে দর্শককে। এটাও একজন নতুন নির্মাতার সার্থকতা বিশেষত্ব দেখাতে পেরেছেন।

  • ছাত্র পড়ায়া কী হবে, স্যার? কয়জন মানুষ হয়? আপনিও তো কতজনরে পড়াইলেন? কয়জন আপনারে দেখতে আসে?
  • না আসলে আর কী করা! সবাই খালি দৌড়াইতে চায়। জীবনে সাফল্য না দরকার সার্থকতা।
    গাছের সাথে কথা-‘তুইও কথা কস না, আমার কথারও কোনো দাম নাই। তোর আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই তয় পার্থক্য একটা আছে, তোর বাতাসে আমার প্রাণ।’
    উনি (শিক্ষক চরিত্রে আবুল হায়াতকে দেখিয়ে) হচ্ছেন জোনাকি পোকা আলো ছড়ান।
    ‘চিড়িয়াখানায় পশুপাখি না রাইখা মানুষ রাখা উচিত। যারা বাপমার খবর রাখে না টিকেট কেটে মানুষ তাদেরকে দেখবে।’
    ‘রতনে রতন চেনে ভোমরায় চেনে মধু
    স্টিমারের সারেং চেনে চিংড়ি মাছ আর কদু’
    এভাবে সূক্ষ্ম জীবনবোধের সংলাপে এবং সাবলীল অভিনয়ে মীর সাব্বির ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার গেটআপই বলে দেয় ডেডিকেশন ছিল চরিত্রটিতে। তার অভিনয়ে সংলাপ ও বডি ল্যাংগুয়েজের গভীরতাই ছিল প্রধান। সংলাপে উপমার অনেক ব্যবহার আছে। ভালো ও খারাপকে অনেক উপমা দিয়ে বোঝানো হয়েছে। বিশেষ করে রূপকার্থের উপমা। ‘সাপ’ ও ‘বেজী’কে সমাজের প্রেক্ষাপটে দেখিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দেয়া হয়েছে।মাল্টিকাস্টিং এ ছবির অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে ফজলুর রহমান বাবুর চরিত্রটি ছিল শক্তিশালী। ঐশীর দ্বিতীয় ছবি এটি এবং ছবির অন্যতম আকর্ষণ হতে পেরেছে। আবুল হায়াতের চরিত্রটি তার জন্য পারফেক্ট।
  • জয়রাজ অনায়াসে তার স্বাভাবিক সুন্দর অভিনয় করেছে এবং লিড রোলে ভিলেন হবার মতো যোগ্যতা তার আছে যেটি নির্মাতারা তাকে নিয়ে ভাবতেই পারেন। তানিন তানহা এত ন্যাচারাল অভিনয় করে অথচ পর্দায় নিয়মিত তাকে দেখা যায় না। আবু হুরায়রা তানভীর, নরেশ ভুঁইয়া, মাজনুন মিজান তাদের চরিত্রে ঠিকঠাক।

মীর সাব্বিরের ক্যামেরা তার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের দেশটা যে কত সুন্দর তার একটা ছাপ ছবিতে রাখা হয়েছে। শিশির ঝরার দৃশ্য থেকে শুরু করে সূর্যের আলোর ঝলকানি যেন চোখ জুড়িয়ে দেয়। মমতাজের ‘ফোটে ফুল ফোটে/রাত জাগা ফুল ফোটে’ গানে প্রকৃতি কথা বলেছে। ‘বানর বন্ধু’ গানের আয়োজন মনে দোলা লাগিয়ে দেয় অনেকটা শৈশবে ঘুরে আসার মতো। মেলার সাথে সাংস্কৃতিক দিকটাকেও ছবিতে রাখা হয়েছে ‘রঙে রঙে দুনিয়াটা’ গানে। নচিকেতার র‍্যাপ গানটা বাড়তি পাওনা ছিল। ব্যাাকগ্রাউন্ড মিউজিক অসাধারণ।

দৈহিক নাকি মানসিক কোন যন্ত্রণা বেশি কাজে দেয়? অনেকে একটা বলবে কম লোক আছে যারা আরেকটা বলবে। এ ছবিতে এর একটা সূক্ষ্ম উত্তর দেয়া হয়েছে। বলা যায় এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে। সুপারন্যাচারাল কিছুও পেয়ে যেতে পারেন ছবি দেখতে দেখতে। মীর সাব্বির মেধার পরিচয় দিয়েছেন এসবে।

একজন উঠতি সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্র নির্মাতাকে উৎসাহ দেয়া উচিত। মীর সাব্বির পরবর্তী সম্ভাবনা চলচ্চিত্র পরিচালনায়। তার পাশে থাকলে সামনে নিয়মিত এমন মানসম্মত ছবি পাওয়া যাবে। এ ফ্যাক্টর অনুযায়ী ‘রাত জাগা ফুল’ আপাতত মাস্টওয়াচ।

রেটিং – ৮/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন