Select Page

রোজী আফসারী : কিংবদন্তির মৃত্যু নেই

রোজী আফসারী : কিংবদন্তির মৃত্যু নেই

‘মায়েরও কথা স্নেহ-মমতা
আছে গানে গানে
রেখো মনে মনে’
‘অর্জন’ ছবির এ গানে রোজী আফসারী বলে যান সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা ও জীবনের কর্তব্যের কথা।

রোজী আফসারী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী। যাদের হাত ধরে দেশীয় চলচ্চিত্র একটি মানসম্মত অভিনয়শিল্পের অধ্যায় গড়েছে তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।

‘আগে পিছে কত মানুষ যাবে সাথী হইয়া
হাসিমুখে মা রবে দুয়ারে দাঁড়াইয়া
দুয়ারে দাঁড়াইয়া দোয়া দেবে
মায়েরও দোয়াতে দুঃখ যাবে’
‘বন্ধু’ ছবিতে ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাবো’ গানে নায়করাজ রাজ্জাক ও উজ্জ্বল দুই বন্ধু মিলে মা রোজী আফসারীকে গানে গানে এ কথাগুলো বলে। নায়করাজের মায়ের চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন এছাড়া ‘নীল আকাশের নিচে, আলোর মিছিল’ ছবিগুলোতে ছিল ভাবীর চরিত্রে। তিনি কত সিনিয়র এবং গুরুত্বপূর্ণ অভিনয়শিল্পী ছিলেন এতেই বোঝা যায়।

‘সংসারে যদি সবকিছুতে টাকার কথা আসে, ভাড়ার কথা আসে তাহলে ছোট থেকে বড় করেছিস, মানুষ করেছিস তার ভাড়া দিতে হবে। কি করে দেবো রে আপা! বুক চিরে কলিজাটা বের করে দেই!’ ‘এই ঘর এই সংসার’ ছবিতে বড়আপা রোজী আফসারীকে অমর নায়ক সালমান শাহ এ কথাগুলো বলে। সেই রাজ্জাক থেকে সালমান শাহ পর্যন্ত তিনি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তিতে এসব মাইলফলক।

মূল নাম শামীমা আক্তার রোজী। চলচ্চিত্রে রোজী সামাদ ও রোজী আফসারী দুটি নামই সুপরিচিত। প্রথম ও দ্বিতীয় স্বামীর নাম যোগ করে নামকরণগুলো হয়। তিনি অভিনেত্রী ও নৃত্য পরিচালক।

জন্ম ২৩ এপ্রিল ১৯৪৯। লক্ষীপুর, নোয়াখালী। মৃত্যু ৯ মার্চ ২০০৭। কিডনি সমস্যায় ভুগে বারডেম হাসপাতালে মারা যান।

প্রথম স্বামী চিত্রগ্রাহক আব্দুস সামাদ, দ্বিতীয় পরিচালক মালেক আফসারী। কবিতা সামাদ তার একমাত্র মেয়ে।

প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র ‘এই তো জীবন’, পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’-এর নায়িকা ছিলেন তিনি।

শৈশব, কৈশোর থেকে থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলেন। মঞ্চের পেশাদার অভিনেত্রী বলেই তাঁর অভিনয় ছিল নিখুঁত এবং বাস্তববাদী।  অভিনয়ে সবচেয়ে প্রশংসিত ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম।’

১৯৬৪ সালে ক্যারিয়ার শুরু করেন। প্রায় ২০০ চলচ্চিত্রে পজেটিভ রোলে অভিনয় করেন মা, ভাবী, বোন, স্ত্রী এসব চরিত্রে। সাদাকালো সময়ে আনোয়ার হোসেন, খলিল তাঁদের স্ত্রী এবং রাজ্জাক, উজ্জ্বল তাঁদের মতো সিনিয়র অভিনেতাদের মা, ভাবী, বোনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এজন্য ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই ‘মা, ভাবী’ ডাকত তাঁকে।

‘এই ঘর এই সংসার’ সিনেমায় বুলবুল আহমেদ, রোজী আফসারী ও সালমান শাহ

‘ওগো’ ডাক দিয়ে বাঙালি নারীর যে স্বামীভক্তি পর্দায় দেখানো হত শাবানার পাশাপাশি রোজীও তাতে জনপ্রিয় ছিলেন। কিডনি সমস্যায় ভুগে মৃত্যুর আগে বাস্তবেই স্বামী মালেক আফসারীকে বলেছিলেন-‘ওগো, তুমি অামাকে একটু ফুঁ দাও। ডাক্তার, কবিরাজ অামাকে ভালো করতে পারবে না। তুমি ফুঁ দিলেই আমি ভালো হয়ে যাব।’ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটি রোজী-র অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে মালেক আফসারী তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। তাঁর শেষ দিনগুলোতে মালেক আফসারীর স্মৃতিচারণ চোখে অশ্রু ঝরায়। বয়সে মালেক আফসারীর থেকে একটু বড় হওয়াতে তিনি শাসন করতেন এবং আফসারী সাহেব মানতেন। তাঁরা সুখী দম্পতি ছিলেন।

রোজী-র মৃত্যুর পর নায়ক মান্না বলেছিলেন-‘একটা ছবিতে লোকসান হলে পরের ছবিতে উঠিয়ে নেয়া যায় কিন্তু রোজী অাপার মতো গুণী অভিনেত্রীকে আনব কিভাবে?’ এফডিসিতে তাঁর নামে ফ্লোর করার প্রস্তাব হলেও পরে অার হয়নি।

ভ্রমণপিপাসু ছিলেন অনেক। ভ্রমণ করেছেন সুইডেন, লন্ডন, মিশর, সিরিয়া, কানাডা, পাকিস্তান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে।

পরিচালকদের মধ্যে নারায়ণ ঘোষ মিতা ও এ জে মিন্টু-র চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন এবং শাবানা, কবরী এ দুজনের সাথে এক চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি ছিলেন।

রোজী আফসারী আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছিলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবি দিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের মতো বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকারের সাথে তাঁকে এক ছবিতে দেখা গেছে। জয়শ্রী কবিরের সাথে তাঁর ভালো বন্ধুত্বও ছিল।

তাঁর অভিনয়ের ব্যাপ্তি প্রায় চার দশক। প্রায় ৩৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলা, উর্দু মিলিয়ে। সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘পরমপ্রিয়।নিজে পরিচালনা করেছেন ‘আশা নিরাশা’ (১৯৮৬) ছবি।

উল্লেখযোগ্য ছবি : বাংলা – এই তো জীবন, বন্ধন, একালের রূপকথা, ভাইয়া, এতটুকু আশা, চোরাবালি, বেদের মেয়ে, আলোর পিপাসা, জোয়ার ভাটা, নীল আকাশের নিচে, প্রতিকার, জীবন থেকে নেয়া, তিতাস একটি নদীর নাম, কাঁচ কাটা হীরে, সূর্যগ্রহণ, সূর্য সংগ্রাম, মিন্টু আমার নাম, অশিক্ষিত, বন্ধু, লাঠিয়াল, ফকির মজনু শাহ, শ্রীমতি ৪২০, ঘরজামাই, ছোটমা, বেলা শেষের গান, নাগ নাগিনী, মোকাবেলা, কলমিলতা, ওরা ১১ জন, সুখের সংসার, স্বামী, ওমর শরীফ, আনারকলি, সেলিম জাভেদ, আলোর মিছিল, রূপালি সৈকতে, নাগরদোলা, টক্বর, মেঘ বিজলি বাদল, সাত রাজার ধন, ইজ্জত, প্রতিহিংসা, চেনা মুখ, নাজমা, চ্যালেন্জ, পদ্মাবতী, জোশ, নরম গরম, সালতানাৎ, রাজদণ্ড, ঘরে বাইরে, গীত, মায়ের দাবি, গোলমাল, শিরি ফরহাদ, রাস্তার রাজা, শশীপুন্নু, ক্ষমা, এই ঘর এই সংসার, বীর সৈনিক, পরমপ্রিয় ইত্যাদি। উর্দু – জাগো হুয়া সাভেরা, সঙ্গম, পুনম কি রাত, উলঝন, সোয়ে নদীয়া জাগে পানি, অর গুম নেহি, হুর এ আরব।

দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০ টি পুরস্কার পেয়েছেন। শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিশাবে ১৯৭৫ সালে ‘লাঠিয়াল’ ছবিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। বাচসাস পুরস্কার, জহির রায়হান পদক, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ‘নিগার’ পদকও পেয়েছেন। তাঁর অভিনয়শক্তি অনুসারে আরো জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্য ছিল।

রোজী আফসারীকে নিয়ে এবছর ২০১৯ সালে গুগল কর্তৃপক্ষ তাঁর জন্মদিনে ডুডল করেছে। এটি আমাদের চলচ্চিত্র এবং তাঁর জন্য অনেক বড় সম্মানের বিষয়। বলতে গেলে বড় অর্জনও। সারাবিশ্ব জানল তাঁর সম্পর্কে।

কিংবদন্তির মৃত্যু নেই।
তাই ‘রোজী আফসারী’ নামটিও অমর থাকবে আমাদের চলচ্চিত্রে। আগামীর অভিনয়শিল্পীরা মাল্টিডাইমেনশনাল অভিনয়ে তাঁকে ফলো করতে পারে অনায়াসে।


মন্তব্য করুন