Select Page

সিনেমার নেপথ্য গল্প: নির্মাণের কথা ছিল না ‘ঘুড্ডি’র

সিনেমার নেপথ্য গল্প: নির্মাণের কথা ছিল না ‘ঘুড্ডি’র

একটি সিনেমায় একজন নির্মাতার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। যেমন; ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া সালাহউদ্দিন জাকীর ‘ঘুড্ডি’। এরপর তিনি আরো কিছু ছবি বানালেও রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা অভিনীত সাদাকালো যুগের ছবিটি ঢালিউডে সবচেয়ে আধুনিক নির্মাণের একটি হয়ে থেকেছে।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সমসাময়িক পরিবেশ বাস্তবসম্মতভাবে উঠে এসেছে ‘ঘুড্ডি’ ছবিতে। একইসঙ্গে ঢাকা আলাদা একটি ‘চরিত্র’ হয়ে উঠেছে। কাহিনি, নির্মাণপদ্ধতি, রাজনৈতিক বক্তব্য- সবদিক থেকে ‘ঘুড্ডি’কে তৎকালীন গতানুগতিক ঢাকাই ছবি থেকে ব্যতিক্রমী ও সফল বলে মনে করেন চলচ্চিত্র সমালোচকেরা। সোনাকান্দা দুর্গ ও কক্সবাজারে আসাদ ও সুবর্ণার সংলাপ বিনিময় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সংলাপ। ‘ঘুড্ডি’ সংলাপ, সম্পাদনা ও চিত্রগ্রহণে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।

ছবিতে আরো আছেন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তারিক আনাম খান ও নায়লা আজাদ নূপুর প্রমুখ। মাঝির চরিত্রে গোলাম মুস্তাফা আর সুবর্ণার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুর চরিত্রে সংগীতশিল্পী হ্যাপী আখান্দ্ অভিনয় করেছেন। ছবিতে ব্যবহৃত হ্যাপীর ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি পেয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা।

‌‘ঘুড্ডি’র নায়ক আসাদের সঙ্গে পরিচালক জাকীর বয়সের ব্যবধান সাত বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সাল থেকে তারা বরাবরই ছিলেন একসঙ্গে। ‘নাট্যচক্র’, ‘ড্রামা সার্কেল’, ‘ঢাকা থিয়েটার’, ‘ফিল্ম সোসাইটি’, পত্রিকা ‘কাঠগোলাপ’, ‘স্বপক্ষে’সহ নানা কিছুতে তারা একসঙ্গে কাজ করেছেন। আসাদ ছিলেন ‘ঘুড্ডি’ ছবির সহকারী। সহকারীকেই নায়ক বানিয়ে দেন জাকী।

আসাদ বলেন, “‘ঘুড্ডি’ জাকী ভাইয়ের প্রথম চলচ্চিত্র হলেও তিনি অনভিজ্ঞ ছিলেন না। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথম সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়তে যান দুজন— একজন সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী। তিনি পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের গোল্ড মেডেলিস্ট ছাত্র। অন্যজন ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বাদল রহমান, যিনি পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নির্মাণ করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।”

“পুনে থেকে পড়াশোনা শেষ করে যেদিন ফিরলেন জাকী ভাই, আমি তাকে রিসিভ করতে গিয়েছিলাম তেজগাঁওয়ের পুরনো এয়ারপোর্টে। আমাদের ফিল্ম সোসাইটি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। ক্লাবটির সভাপতি ছিলেন জাকী ভাই। এয়ারপোর্ট থেকে আসতে আসতে বললাম, বলেন তো জাকী ভাই কী শিখে এলেন? আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আই হ্যাভ লার্ন, হাউ টু লার্ন। এই তিন বছরে শিখেছি কী করে শিখতে হয়। এখন শিখে তারপর কাজ করব।’ এই হচ্ছেন সালাউদ্দীন জাকী। আমরা তো কিছু না জেনেই বলি সব পারি, আমাকে সুযোগ দেয় না। টাকা দিলেই আমি বানিয়ে ফেলব।”

‘ঘুড্ডি’র ৪০ বছর পর নির্মাতার সঙ্গে দুই অভিনেতা

মজার বিষয় হলো, জাকী শুরুতে ‘ঘুড্ডি’ বানাতে চাননি বা এ সিনেমা তার মাথায় ছিল না। এ নির্মাতা বলেন, “সেলিম আল দীনের ‘চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি’ অবলম্বনে ছবি করার কথা ছিল। সেলিম নিজেই স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছিলেন। মালিবাগে শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রীর বাসার গ্যারেজে আমি অফিস নিয়েছিলাম। সেখান থেকে শুটিংয়ের ঠিক আগের দিন স্ক্রিপ্টটা চুরি হয়ে গেল। সেলিম বলেছিলেন, আবার লিখে দেবেন। কিন্তু আমার জেদ চাপল। অপেক্ষা না করে নির্দিষ্ট দিনেই শুটিং শুরু করলাম। একেবারে নতুন কাহিনি। তাৎক্ষণিকভাবে ভাবা, তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া।”

“আসলে ‘ঘুড্ডি’ নির্মাণ হয়েছে কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়াই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগ্রামের প্রেরণা, পুনের সৃজনশীল প্রেরণা আর জেদ মিলিয়েই এই চলচ্চিত্রের সৃষ্টি। আসাদকে বললাম, তুই একজন মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র জমা দিয়ে এখন খালি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। তুই তোর নিজের চরিত্রেই অভিনয় করবি। সুবর্ণা মোস্তফাকে বললাম, ভাবো, তুমি আর্কিটেকচারের ছাত্রী। যারা একসময় বাম রাজনীতি করে আমাদের পথ দেখিয়েছেন পরবর্তীকালে তারা বিত্তবান হয়ে পথ হারিয়েছেন— এমন চরিত্রে অভিনয় করলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। তার মেয়ের চরিত্রে সুবর্ণা। মেয়েটি দ্বন্দ্বে ভোগে। ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুড্ডির মতো ওড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা শিকড়ের সন্ধান করে সে। সেই শিকড়ের পথ দেখায় আসাদ। নৌকায় শেষ হয় ওদের গল্প।”

নায়লা আজাদ নুপূর ও আসাদ

 ‘ঘুড্ডি’ ছবির আগে রাইসুল ইসলাম আসাদ অভিনয় করেছিলেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিতে। তিনি বলেন, “আমি ছিলাম ছয় কি সাত নম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট। ইউনিটের সঙ্গে গেছি শুটিং করতে। শুটিং করার কথা ছিল ধানমন্ডিতে, সেই শুটিংয়ের গাড়ি চলে গেল নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে সোনাকান্দা বন্দরে গিয়ে পরিচালক বললেন, ‘তুমি আর সুবর্ণা এখান থেকে হেঁটে চলে যাও!’ এটাই হচ্ছে ছবির প্রথম শট। আমি বললাম, মানে কী!”

পরিচালক সালাহউদ্দিন জাকী স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘এক শুক্রবার শুটিংয়ের কল দেওয়া হয়। প্রথম দিনের শুটিং। সবাই প্রস্তুত— সুবর্ণা মুস্তাফা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, ফরিদ আলী, তারিক আনাম খান, লাকী আখান্দ্, হ্যাপী আখান্দ্, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ক্যামেরার শফিকুল হক স্বপন, সম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুল, সহকারী বিকাশ দত্ত আরও অনেকে।

তিনটি গাড়ি— একটা চালাচ্ছে স্বপন, ওরই গাড়ি। পাশে আমি, পেছনে সুবর্ণা, আসাদ। আরেকটি চালাচ্ছে ফরিদ আলী, আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু। ওর গাড়ি আমাকে দিয়েছিল শুটিংয়ের জন্য।

পড়ুন রিভিউ: শত শত ‘ঘুড্ডি চাই’

কক্সবাজারে শুটিং টিম

ক্যামেরা আর লটবহর আছে শেষ গাড়িতে! গাড়িতে উঠে চোখ বুজে বললাম, চল নারায়ণগঞ্জ স্টিমারঘাটে। ঘাটে পৌঁছে শীতলক্ষ্যা পার হলাম, পরিত্যক্ত সোনাকান্দা দুর্গ, পৌঁছে গেলাম! পথে সুবর্ণা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, ‘চরিত্রটা কী, বললেন না তো?’ কী জবাব দেব? আমি নিজেই জানি না! হুট করে বললাম, এই ধর তুই স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী, কেমন? সুবর্ণার প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি পেছনে তাকিয়ে। এবার আসাদের পালা। ভরাট গলায় তার প্রশ্ন, ‘আর আমি?’ জবাব না ভেবেই দিলাম, তুই? তুই আসাদ, আসাদই! যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়ে হাতটা খালি, শহর চাষ করে বেড়াস।

ও কী বুঝল, জানি না! ছোট্ট করে প্রতিক্রিয়া দিল, ‘হু’। দুর্গে পৌঁছে ক্যামেরা বসিয়ে সুবর্ণাকে বললাম, তুই ক্যামেরার ডান দিক দিয়ে ইন করে ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবি, আর আসাদ বাঁ দিক দিয়ে, দুজনই ব্যাক টু ক্যামেরা, কেমন? ওদের জীবনের প্রথম শট, ব্যাক টু ক্যামেরা। অবশ্য ওদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, অভিনয়জগতের সিঁড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছে ধ্রুবতারার জগতে। সুবর্ণা ওই দিন থেকে চলনে-বলনে পাক্কা আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টির ছাত্রী বনে গেল।”

পরিচালকের স্মৃতিচারণায় আরেক দিনের কথা উঠে আসে। ছবির শেষ সময়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এক বিকেলের কথা। তিনি স্মৃতিচারণা করেন এভাবে।

‘আউটডোর, স্বল্প বাজেট, অল্প ম্যাটেরিয়াল নিয়ে গিয়েছি কক্সবাজারে! শেষ দিন, শেষ বেলা। আর থাকার পয়সা নেই আমাদের। কিন্তু মাথায় আছে লম্বা একটি সিকোয়েন্স। এক টেকে ওকে করতে হবে। কারণ, আর ম্যাটেরিয়াল নেই।’

‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’র গায়ক হ্যাপী আখান্দের সঙ্গে সিনেমায় সুবর্ণা

এই দিনের স্মৃতিচারণা করে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, ‘এদিকে টাকা শেষ। শুটিং ফিল্ম যা আছে, তা–ও অল্প। আর নেই। জাকী ভাই দৃশ্যটা একবারেই শুটিং করতে চায়। কবিতাটা আমাকে দিল। বললাম, আমাকে একটু সময় দিতে হবে। এরপর কবিতা নিয়ে রুমে চলে গেলাম। লিখে লিখে মুখস্থ করলাম। পুরোটা মুখস্থ করে বিচে গেলাম। পুরো ইউনিট প্রস্তুত। আমি সামনে, আসাদ পেছনে—পুরোটা এক শট। সিনেমার চেয়েও সিনেম্যাটিক হচ্ছে, কবিতাটা শেষ হলো। ফিল্ম শেষ হওয়ার ক্র্যাক করে শব্দ হলো। আসাদ বালুর ওপর বসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। কারণ, ভীষণ আবেগের ব্যাপার ছিল। স্বপন ক্যামেরা সহকারীর হাতে দিয়ে, এক লাফে সমুদ্রে। ওই মুহূর্তের কথা বলে বোঝানো সত্যিই সম্ভব নয়।’

সেদিনের স্মৃতিচারণা করে পরিচালক বলেছিলেন, ‘ছোট্ট ইউনিট নিয়ে জিপে একটানে হিমছড়ি। সুবর্ণা প্রম্পট করতে মানা করল। ওর মুখাবয়বে কোনো টেনশন নেই, মুখটি আশ্চর্যজনকভাবে নিরুদ্বিগ্ন! এদিকে আমরা আছি ভীষণ দুশ্চিন্তায়। যদি ফিল্ম রানআউট হয় বা সুবর্ণা ভুল করে বসে, এনজি হয়, তবে আর উপায় নেই, মাঠে মারা যাবে সবকিছু। বিদায় সমুদ্রস্বপ্ন! সবাই চুপ!

শুধু দু-একটি গাঙচিল আকাশে যেন উন্মুখ উড়ছে সুবর্ণার সংলাপ শোনার জন্য। ওরাই তো পৌঁছে দেবে সুবর্ণার বার্তা দূর সমুদ্রের বুকে ভাসমান নাবিকের কাছে। দীর্ঘ সংলাপে তা-ই লেখা আছে। অতঃপর বললাম, অ্যাকশন। শট শুরু হলো। আমার কান সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে শুনতে চাইছে ওর কণ্ঠ-সংলাপ।

সুবর্ণা আনমনা এগিয়ে আসছে, পেছনে উদ্বিগ্ন আসাদ, ও বলতে চাইছিল কিছু একটা, কিন্তু সুবর্ণা তখন ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন জগতে, গাঙচিলের ডানায় অজানার সন্ধানে। ৩৫ মিলিমিটারের ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ব্যাক স্টেপ দিচ্ছে স্বপন। সন্দেহ নেই কাজটি কঠিন। একটু ঝাঁকি খেলে বা সুবর্ণা ভুল করলে অথবা শেষ মুহূর্তে এসে ফিল্ম রানআউট হলে তীরে এসে তরি ডুববে। রিটেকের আর অবকাশ নেই। শেষ দিকে কিছুই শুনতে পারছিলাম না কানে, এমনকি সমুদ্রের কণ্ঠও, সব ব্ল্যাঙ্ক, চারপাশে যেন ভয়াবহ শূন্যতা। স্বপন দাঁড়িয়ে গেছে, ওরাও। স্বপনের দিকে তাকিয়ে আমি সুবর্ণাকে বললাম, একটা কিছু বল…। আমার দিকে তাকাল স্বপন। তবে ওর মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। তবে কি শট সম্পূর্ণ হয়নি? এনজি? হায় সমুদ্র! তুই কী নিষ্ঠুর!

আচমকা স্বপন একটু হেসে বলল, ‘ওকে, বস।’ ব্যস! আমি প্রায় হুংকার দিয়ে ঘোষণা দিলাম, ওকে ওকে ওকে। সুবর্ণা তখনো নিশ্চুপ-নিশ্চল দাঁড়িয়ে অভিব্যক্তি ধরে রেখেছে, যেন সে কিছু শুনতেই পায়নি।”

এত সংগ্রামে করা সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহ থেকে লগ্নি তুলে আনতে পারেনি। আসাদ বলেছিলেন, সেই টাকার পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগও ওঠেনি। সুপার ফ্লপ হয়েছিল ছবিটা। জাকী ভাইয়ের বন্ধু ছবিটা প্রযোজনা করেছিলেন। সেই টাকা ফেরত দিতে পারেননি। ছবি না বানিয়ে টাকার জন্য পরে তাকে এফডিসিতে চাকরি নিতে হয়েছে। এগুলো কেউ কখনো জানতে চায় না।

তিনি বলেন, এই ছবির পরে কেন তিনি আর ছবি বানাননি, এসব কেউ ভাবেন? টাকা নেই, পয়সা নেই। তখন ছয়-সাত শ টাকায় রিল পাওয়া যেত। সেটা কেনারই সামর্থ্য ছিল না। আলমগীর কবির সাহেব ক্যামেরা দিয়ে বলেছেন, বানাও, টাকা লাগবে না। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট একটা ছবি বানাতে বেশি টাকা লাগেনি।

বাণিজ্যিক ছবির বাজারে আসাদ-সুবর্ণারা ছিলেন অপরিচিত। এ কারণে হলমালিকেরা নিতে চাননি ছবিটি। অথচ ছবিটি বানাতে গিয়ে সালাহউদ্দিন জাকীর স্ত্রী গয়না বন্ধক দিয়েছিলেন তাঁতীবাজারের এক দোকানে। তবে এ নিয়ে মোটেও আক্ষেপ ছিল না তার। জাকী বলেছিলেন, “মনের আনন্দে ছবিটি বানিয়েছিলাম। শিল্পীরা কেউ পারিশ্রমিক নেননি। কিছু সিনেমা হলে চললেও আমাদের অনভিজ্ঞতার কারণে ঠিকমতো টাকাও আসেনি। তবে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। যদিও একদল যেমন পিঠ চাপড়েছে, আরেক দল ফেলেও দিয়েছে ‘ঘুড্ডি’।”

‘ঘুড্ডি’র পর কেন আর সেই ধারের ছবি বানাননি জাকী। এ প্রশ্ন সবার। জাকী বলেছিলেন, “১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ঘুড্ডি’র বিষয়ে একদল বলে, এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। ছবি। আরেক দল ঠিক উল্টো কথা বলে। যাহোক, আমি সমালোচনা সহ্য করতে পারি। সমালোচনা একটা শিল্প। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প তখনো পাকা হয়নি। ঘুড্ডি তার শিকার। ১৯৬৫ সালে নির্মিত সাদিক খানের ‘নদী ও নারী’ নিয়েও একই কথা বলতে পারি। ‘ঘুড্ডি’র পর চলচ্চিত্র নির্মাণে নিয়মিত হতে পারিনি। এই সিনেমা বানাতে গিয়ে স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখেছিলাম। এত বছরেও সেগুলো পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারিনি। ফলে চাকরির মোহের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি।”

১৯৮০ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে উত্তর-আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘ঘুড্ডি’। সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর পরিচালনায় ছবিটির উদ্ভাবনী ও জটিল চলচ্চিত্র-কৌশল সেই সময় আলোচিত হয়েছিল, জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ছবিতে আবহসংগীতের দারুণ ব্যবহারও প্রশংসিত হয়। গতানুগতিক ছবির কাঠামো মেনে এ চলচ্চিত্রে রূপকের মাধ্যমে শক্তিশালী রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল।

ছবিটিতে পরিচালকের ক্যামেরায় বারবার উঠে আসে ঢাকার রাস্তাঘাট, সরু গলি, বুয়েট ক্যাম্পাস, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল, পাঁচ তারকা হোটেল, সাভারের স্মৃতিসৌধ, পানামনগর, নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা দুর্গ, বুড়িগঙ্গা নদী। আফজাল হোসেন ছবির পোস্টার ডিজাইন করেছিলেন। চিত্র সমালোচকদের মতে, চাকচিক্য আর বিনোদনসর্বস্ব অগভীর চলচ্চিত্রের প্রতি পরিচালকের সমালোচনা আর বিরোধিতা ‘ঘুড্ডি’তে উঠে আসে বারবার। কখনো কখনো গতানুগতিক রোমান্টিক গল্পের আবহ লক্ষ করা গেলেও কিছু নির্দিষ্ট কৌশল ও বক্তব্য ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পরিচালক শুধুই বিনোদন জোগানো চলচ্চিত্র থেকে ‘ঘুড্ডি’র ভিন্নতা প্রমাণিত হয়। আবার অনেকের মতে, গান ও আবহসংগীতের ব্যবহার, সাহসী সমালোচনা আর রাজনৈতিক বক্তব্য ছবিটিকে প্রথাবিরোধী এবং প্রতিবাদী করে তুলেছে।

পরিচালকের প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছে একদিকে বাণিজ্যিক ছবির গতানুগতিকতা আর অগভীরতার প্রতি, অন্যদিকে সমাজে টিকে থাকা রাজনৈতিক সমস্যার বিরুদ্ধে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘ঘুড্ডি’ সফল একটি রাজনৈতিক সিনেমা হিসেবেও।

*প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ ও ফিল্ম ফ্রিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকার অবলম্বনে


Leave a reply