সুরের জাদুকর আলম খান
একবার ভাবুন তো সেই ১৯৮৩ সালের ছবি ‘নাগ পূর্ণিমা’-তে আলম খান তাঁর কালজয়ী গান ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’ রক ধাঁচে করেছিলেন। কতটা আধুনিক হলে এমন ক্লাসিক একটা গান তিনি রক ধাঁচে তৈরি করলেন! আমরা যারা এখন যুগ এগিয়ে গেছে বলে আধুনিকতার ধুয়া ধরি মূলত প্রকৃত আধুনিক ছিলেন আলম খানের মতো মানুষেরাই যারা সময় ও চিন্তা দুই দিক থেকেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। গানটির মিউজিক কম্পোজ এত ইউনিক ছিল যে শুনতেই ভালো লাগে।
তারপর ভাবুন ‘সারেং বৌ’ ছবির কালজয়ী গান ‘ওরে নীল দরিয়া’-র কথা। এ গান তৈরির পেছনের গল্পটা তিনি একটা সঙ্গীতানুষ্ঠানে বলেছিলেন। ছবির প্রযোজককে বলেছিলেন গানটার কথার সাথে তিনি কিছু কাজ করতে চান সেজন্য খরচ হবে প্রযোজক বলেন যত খরচ হয় হোক। গানে আছে নায়ক ফারুক ট্রেন ও নৌকায় করে আসে। ট্রেনের যে শব্দ এটা অনেক ছবিতেই কমন তাই আলম খান চাইলেন ব্যতিক্রমী কিছু করতে। ট্রেন যখন লাইন ক্রস করে জয়েনগুলোতে ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ হয়। এ রিদমটা মিউজিকে আনার জন্য তিনি কাঠ, পাটকাঠি এনে কেটে ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ বের করেন এবং সেটা গানে কাজে লাগান। তারপর নায়কের নৌকায় আসার যে দৃশ্য ছিল সেখানে বৈঠার একটা আওয়াজ পানির সাথে ম্যাচ করে করলেন। সেটার জন্য রেডিও অফিস থেকে একটা যন্ত্র আনেন। যন্ত্রটির সাথে পানির সাউন্ড অ্যাফেক্ট আনেন ছাপ ক্যাচ ট্রুরু এমন একটি আওয়াজে। নায়ক যখন গ্রামে ঢুকছে তখন তবলার আওয়াজ যেটি মাটির টানকে মিন করে। গান রেকর্ডিং-এর সময় আলম খানের কাজ দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে গানটির শিল্পী আব্দুল জব্বার তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। এভাবে তখনকার সময়ের যতটুকু প্রযুক্তি ছিল তার মধ্যেই পারফেক্ট জিনিসটি পাওয়ার জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন যার জন্য গানটি কালজয়ী।
গানের সুরের জন্য যার এত ক্ষুধা এবং চেষ্টা ছিল তিনি তো কিংবদন্তি হবেনই। একজন আলম খান দেশের চলচ্চিত্রে কালজয়ী সুরকার।
ব্রিটিশ ভারতের সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর বাবার সাথে ঢাকায় আসেন। কিংবদন্তি শিল্পী আজম খান তাঁর ছোটভাই। স্ত্রী গুলবানু ছিলেন গীতিকার যিনি কালজয়ী গান ‘তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছ’ গানটি লিখেছেন।
ক্যারিয়ারের শুরুতে রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। কবি সৈয়দ শামসুল হকের কথায় ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির গানগুলো তাঁকে পরিচিতি দেয় এবং তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করেন। এরপর শুধুই সাফল্য আর সাফল্য। একের পর এক কালজয়ী হিট গান তিনি উপহার দিতে থাকেন।
অনেকে হয়তো জানে না উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী কুমার শানু-র প্লেব্যাক ক্যারিয়ার শুরুই হয় আলম খানের গানে। ‘তিনকন্যা’ ছবির টাইটেল সং ‘তিনকন্যা এক ছবি’ গানটিই কুমার শানু-র প্রথম গান প্লেব্যাকে। গানটি প্রথমে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়ার কথা ছিল তিনি একটা কারণে স্টুডিওতে যেতে না পারলে কুমার শানু সুযোগটি পান। পরে কুমার শানু এন্ড্রু কিশোরকে বলেন-’দাদা, সুযোগ পেলাম তাই মেরে দিলাম আপনি রাগ করেননি তো!’ এন্ড্রু কিশোর বলেন-’ওটা আপনার ভাগ্যে ছিল।’
হায়রে মানুষ রঙিন ফানুশ – বড় ভালো লোক ছিল
তুমি যেখানে আমি সেখানে – নাগ পূর্ণিমা
ওরে নীল দরিয়া – সারেং বৌ
চুমকি চলেছে একা পথে – দোস্ত দুশমন
আজকে না হয় ভালোবাসো – মিন্টু আমার নাম
তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছ – জীবননৌকা
ওরে ও জান রে – জীবননৌকা
আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো – রজনীগন্ধা
তিনকন্যা এক ছবি – তিনকন্যা
এক চোর যায় চলে – প্রতিজ্ঞা
তেল গেলে ফুরাইয়া – ত্যাগ
জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প – ভেজা চোখ
প্রিয়া আমার প্রিয়া আজ চিঠি দিয়েছে – ভেজা চোখ
তুই তো কাল চলে যাবি – ভেজা চোখ
বুকে আছে মন – লড়াকু
সুর ঝরা এই আলোর মেলায় – আওয়ারা
সবাই তো ভালোবাসা চায় – সারেন্ডার
তোমরা কাউকে বোলো না – বিশ্বপ্রেমিক
ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে – রঙিন প্রাণসজনী
চাঁদের সাথে আমি দেবোনা – আশীর্বাদ
মন্দ হোক ভালো হোক বাবা আমার বাবা – সত্য মিথ্যা
ও আমার বন্ধু গো – কেয়ামত থেকে কেয়ামত
এখন তো সময় ভালোবাসার – কেয়ামত থেকে কেয়ামত
একা আছি তো কি হয়েছে – কেয়ামত থেকে কেয়ামত
বাবা বলে ছেলে নাম করবে – কেয়ামত থেকে কেয়ামত
ও সাথীরে যেও না কখনো দূরে – স্বপ্নের ঠিকানা
এইদিন সেইদিন কোনোদিন – স্বপ্নের ঠিকানা
নীল সাগর পার হয়ে – স্বপ্নের ঠিকানা
যদি সুন্দর একখান বউ পাইতাম – স্বপ্নের ঠিকানা
ভালোবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া – অন্তরে অন্তরে
এখানে দুজনে নিরজনে – অন্তরে অন্তরে
কাল তো ছিলাম ভালো – অন্তরে অন্তরে
এ জীবনে যারে চেয়েছি – প্রিয়জন
আমাদের ছোট নদী – এই ঘর এই সংসার
আমি যে তোমার কে – বিচার হবে
সবার জীবনে প্রেম আসে – ভাংচুর
আমি একদিন তোমায় না দেখিলে – দুই জীবন
তুমি আজ কথা দিয়েছ – দুই জীবন
আবার দুজনে দেখা হলো – দুই জীবন
তুমি ছাড়া আমি একা – দুই জীবন
আব্বু আমার বন্ধু – দুই জীবন
তোমাকে আমার কিছু বলার ছিল – প্রিয়শত্রু
চিঠি কেন আসেনা – প্রিয়শত্রু
এতদিন খুঁজেছি যারে – প্রিয়শত্রু
বন্ধু আমার থাকে রে লন্ডন – প্রিয়শত্রু
আর যাব না এমেরিকা – অচেনা
তোমার নাম লিখে দাও – অনুতপ্ত
ও সাথী রে আমারই জীবন শুধু তুমি – ভণ্ড
ঐ মেয়েটি বড় সুন্দরী – প্রিয়জন
তুমি চাঁদের জোছনা নও – হৃদয়ের আয়না
কাছে আসতে আসতে এত কাছে এসেছি – অর্জন
আকাশেতে লক্ষ তারা – কুলি
যারে ভালো লাগে যারে ভালোবাসি – কুলি
কেঁদো না ব্যথা পেলে কেঁদো না – ঘৃণা
বেলী ফুলের মালা পরে – বেপরোয়া
মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে – বেপরোয়া
শিখা আমার শিখা – বিশ্বপ্রেমিক
এ কি কথা শুনাইলি রে – বিশ্বপ্রেমিক
কত ভালোবাসি আমি তোমাকে – বিশ্বপ্রেমিক
মনে মনে যারে আমি খুঁজি – শয়তান মানুষ
ভালোবাসতে গিয়ে আমি – দুই বধূ এক স্বামী
সবারই মনে আছে একটি আশা – অন্তরে ঝড়
তোমার ঐ মিষ্টি হাসি – অনন্ত ভালোবাসা
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার :
বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২)
তিনকন্যা (১৯৮৫)
সারেন্ডার (১৯৮৭)
দিনকাল (১৯৮২)
বাঘের থাবা (১৯৯৯)
এবাদত (২০০৯)
কি জাদু করিলা (২০১০)
ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর আজ ৮ জুলাই ২০২২ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
একজন আলম খান দেশের চলচ্চিত্রকে যা দিয়ে গেছেন তা অসামান্য। অসংখ্য কালজয়ী গানের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন চলচ্চিত্রে। ভাইরাল, অ্যাটেনশন সিকিং জাতীয় সস্তা পাবলিসিটির বর্তমান সঙ্গীতাঙ্গন একজন আলম খানকে হয়তো বুঝতে পারবে না কিন্তু প্রকৃত সঙ্গীতের ক্ষুধা যাদেরকে টানে তাদের কাছে আলম খান হয়ে থাকবেন চিরস্মরণীয়।