আমাদের মাহফুজ আহমেদ
‘নুরুল হুদা’ গ্রামের ছেলে, একটু বোকা, বেশি আবেগী আবার স্বপ্নবিলাসীও। প্রেমে পোড় খাওয়া এই ছেলেটি জীবন যুদ্ধে বারবার হেরে গিয়ে, পাতার বাঁশিতে ‘কী যাদু করিলা’ গানের সুর উঠিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। জনপ্রিয় ধারাবাহিক সিরিজ ‘নুরুল হুদা’য় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি, আবার চলচ্চিত্রে ‘সুরুজ’ হয়ে ভালোবাসার মানুষের রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে গেয়ে উঠেন ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’…….!
বাংলা নাটকে তিনি দেবদাস হয়েছেন, চৈতা পাগল হয়েছেন……আবার চলচ্চিত্রে দেশপ্রেমিক সবুজ হয়ে গেয়ে উঠেন সবুজের বুকে লাল সে তো উড়বেই চিরকাল।রোমান্টিক অভিনেতা হিসেবে নিজেকে করেছেন প্রতিষ্টিত। নিজেকে শুধু অভিনয়ে সীমাবদ্ধ রাখেননি, পরিচালনাতেও নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন, যার প্রমাণ মিলে খেলা, হ্যালো বাংলাদেশ, শেষের কবিতার পরের কবিতা নাটকগুলো দিয়ে। তিনি টেলিভিশন জগতের অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে একজন ‘মাহফুজ আহমেদ’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়াশুনাকালীন বিনোদন পাতায় লিখতেন। সেই সুবাদে ইমদাদুল হক মিলনের পরামর্শে জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘কোন কাননের ফুল’-এ ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করার মধ্য দিয়ে টিভি নাটকে নাম লিখান। এরপর হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’তে বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়া মতি চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি।
নব্বই দশকে অনেক জনপ্রিয় অভিনেতার ভিড়ে তিনি মূলত পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করতেন, তবে ‘শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ নাটকটি আলাদা পরিচিতি এনে দেয়, ততদিনে সবুজ ছায়া, সবুজ সাথী, আগুন মজিদ, জইতরী, নীতু তোমাকে ভালোবাসির সুবাদে হয়ে উঠেন হুমায়ূন আহমেদের আস্থাভাজন অভিনেতা। সঙ্গে ছিল ফেরদৌস হাসানের শোধ, পান্থজনের সখার মত আলোচিত নাটক।
এর পরের দশকে একাগ্রতা ও দারুন অভিনয়ে সবাইকে ছাপিয়ে নিজেকে নিয়ে যান টিভি নাটকের শীর্ষ অভিনেতার আসনে। বিশেষ করে জনক, দেবদাস, উত্তর পুরুষের পর মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘৫১ বর্তী’তে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন, পাশাপাশি ছিলো হুমায়ূন আহমেদের সমুদ্রবিলাস প্রাইভেট লিমিটেড, হাবলঙ্গের বাজারে, যমুনার জল দেখতে কালো, ২৪ ক্যারেট ম্যান, মায়াবতী নাটকগুলো।
এরপর আসে সুবর্ণ সময়, বিটিভিতে অরণ্য আনোয়ারের ‘নুরুলহুদা একদা ভালোবেসেছিল’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে সর্বমহলে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেন, এই নাটকের সাফল্যের রেশ ধরে অতঃপর নুরুলহুদা ও আমাদের নুরুলহুদা দুটি সিরিজ বের হয়, এই দুটিও বেশ জনপ্রিয় হয়। বিটিভির দৌড় ও ‘মনোবীক্ষণ যন্ত্র’ নাটক দুটিও বেশ আলোচিত।
এই সময়ে তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে লোভ, গোলাপ কেন কালো, অলরাউন্ডার, তোমাকে ছুঁয়ে, বালক বালিকা, প্রিয় বান্ধবী, মন্থন, কথা ছিল অন্যরকম, বিয়ের আংটি, বালিঘর, স্বপ্নসিঁড়ি, দূর্ঘট, শোধবোধ, শূন্যস্থান পূর্ণ, কিংকর্তব্য, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমনের শুভেচ্ছা, মধ্যরাতের অশ্বারোহী, চলমান ছবি, রাত্রির ফুল, ফুল একা একা ফোটে, ক্রাইম রিপোর্টার, এসএমএস, লেখকের মৃত্যু, লীলাবতী, আবেগ অন্যতম।
‘চৈতা পাগল’ ধারাবাহিকে নাম ভূমিকায় অভিনয় ছিল ক্যারিয়ারের অন্যতম অর্জন। অভিনেতা হিসেবে আগের মতো সেই ব্যস্ততা নেই, চলতি সময়ের স্যাটায়ার ভিত্তিক বা কমেডি ধারার নাটকে অভিনয় করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না বলে এইধারার বহু নাটক অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে দুয়েকটি নাটকে অভিনয় করলেও দর্শকরা পছন্দ করেছেন যেমন নীল গ্রহ, ওগো বধূ সুন্দরী কিংবা তোমারি প্রেমে প্রতিদিন। যদিও সাম্প্রতিক কালে একেবারেই অভিনয়ে দেখা যায়নি।
নাটকের এই শীর্ষস্থানীয় এই অভিনেতা চলচ্চিত্রেও সফল।প্রথম ছবির নাম ‘প্রেমের কসম’। শ্রাবণ মেঘের দিন ও দুই দুয়ারী দিয়ে পৌঁছে যান শহর থেকে গ্রামে। জয়যাত্রায় বৈধনে দেখিয়েছেন চলচ্চিত্রে সেরা অভিনয়, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন লাল সবুজ ও জিরো ডিগ্রী ছবি দিয়ে। চার সতীনের ঘর, বাঙলা, মেঘের পরে মেঘেও ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। এছাড়া বেশকিছু বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করেছেন এরমধ্যে ভালোবাসি তোমাকে, আজ গায়ে হলুদ, কেন ভালোবাসলাম, মরণ নিয়ে খেলা, আমার প্রেম আমার অহংকার, কপাল অন্যতম। বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবেও বেশ সুপরিচিত; এর মধ্যে হেনোলাক্স ও ফিজ আপের বিজ্ঞাপন করে দারুণ আলোচিত হন।
অভিনয়, মডেলিং এর বাইরে পরিচালক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্টিত করেছেন। প্রথম পরিচালিত নাটক ‘তাহারা’। এরপর ‘আমাদের নুরুলহুদা’ ধারাবাহিক নাটকটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন। একে একে তোমার দোয়ায় ভালো আছি মা, চৈতা পাগল ধারাবাহিক নির্মাণ করেন। অসংখ্য জনপ্রিয় একক নাটক ও টেলিফিল্ম নির্মাণ করেছেন এর মধ্যে টিভি নাটকের জনপ্রিয় প্রধান অভিনেতাদের মধ্যে যারা নাটক নির্মাণে এসেছেন তাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে সফল সেটা বনলতা সেন, গণি সাহেবের শেষ কিছুদিন হউক কিংবা কেবলই রাত হয়ে যায়-র মতো নাটক। নাট্য প্রযোজক হিসেবেও রয়েছে সুখ্যাতি। ‘জিরো ডিগ্রী’ ছবিটি তাঁরই প্রযোজিত ছবি। তবে কয়েক বছর ধরে তিনি আর নাটক নির্মাণ করছেন না। বর্তমানে ওয়েব জগতের সুবসন্তে উনাকে দেখার তীব্র প্রত্যাশা রইলো।
বর্ণিল ক্যারিয়ারে দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, দর্শক জরিপে পাঁচবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারিনের সাথে বাঁধা জুটিকে বলা হয় টিভি নাটকের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় জুটি। এছাড়া অপি করিমের সাথে জুটিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া শমী, বিপাশা থেকে রিচি, শ্রাবন্তী কিংবা তিশা সবার সাথেই দারুণ মানিয়ে যান। নাটকের প্রায় সব কিংবদন্তীদের নিজের নাটকে অভিনয় করিয়েছেন, তার নির্মিত নাটক অভিনয়শিল্পীদের ক্যারিয়ারে বিশেষ হয়ে আছে।
সাংবাদিকতার সুবাদে হুমায়ূন আহমেদ কে নিয়ে প্রশ্ন গুলো বই আকারে বের করেছেন।
১৯৬ সালের ২৩ অক্টোবর মাহফুজ আহমেদের জন্ম।
বিয়ে করেছেন রাজনীতিবিদ জি এম কাদেরের মেয়ে ইশরাত জাহান কাদেরকে, সংসারে রয়েছে দুটি সন্তান।