ওরাও নতুন করে হারাক ‘অবাক ভালোবাসায়’: আশিকুজ্জামান টুলু
[বাংলা ব্যান্ড ও আধুনিক গানের কিংবদন্তি আশিকুজ্জামান টুলু। সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলায় ওয়ারফেজ পরিবেশিত ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি বিএমডিবি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।]
অনেকের ভালোলাগেনি অবাক ভালোবাসার নতুন কম্পোজিশনটা । আমি বলেছিলাম আমার কেন ভালো লেগেছে সেটা বলবো পরে । আজ সময় পেলাম তাই লিখলাম ।
ভালো একটা উপন্যাস পড়ার পরে যদি সেই গল্প দিয়ে বানানো সিনেমা দেখা হয়, অনেকেরই ভালো লাগেনা । মনে হয় এই জায়গাটা এরকম কেন করলো, এই ক্যারেক্টারটা ঠিক মতো ফুটাতে পারেনি, গল্পের নায়িকার সাথে সিনেমার নায়িকা মিলছেনা । অর্থাৎ বিবিধ অমিল দেখা যায় । এটার কারন উপন্যাসটা পড়ার সময় যে যার নিজের মনের মতো করে চরিত্রগুলি বানিয়ে নিয়ে একটা কাল্পনিক জগতে বাস করে । কিন্তু যখন সিনেমায় পাত্র পাত্রী ওর মনের পাত্র পাত্রীর সাথে মেলেনা, তখন মনটা ডিনায়ালে চলে যায় । গানের ব্যাপারেও তাই ঘটে । সুবির সেনের কন্ঠে সারাদিন তোমায় ভেবে শুনে যে ভালোলাগাটা তৈরি হয়েছিল, শ্রীকান্তর গলায় শুনে অনেকের ভালো লাগেনি । কারন ঐ যে ভালোলাগা ভালোবাসাটা তৈরি হয়েছিল, সেটা পরের এডিশনে হারিয়ে গিয়েছে বলে অনেকের ধারনা । আবার একদল লোকের কাছে নতুন্টাই ভালো লাগে । এই বিষয়টা যার যার নিজস্ব ব্যাপার, এ ব্যাপারে কেউ রাইট না, কেউ রঙ না । কিছু মানুষের মন সব সময় পুরনো একটা জিনিসকে খুব সহজে রিপ্লেস করতে চায়না নতুন দিয়ে । এটা একটা হিউম্যান সাইকোলজি ।
অবাক ভালোবাসা আগেরটা অনেক আগেই শুনেছি, এখন নতুনটাও শুনলাম । একান্তই আমার মতামতঃ আগেরটায় ছোট্ট পরিসরে সউলটা অনেক বেশী, ডিপ অরগানিক মিউজিক কম্পোজিশন, গান তো সেই পাগল করা গান, যেটা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয় সলিল চৌধুরীর গান শুনছি । অর্থাৎ ভীষণ ম্যাচিওরড কম্পোজিশন । কিন্তু এখনকার মিউজিক কম্পোজিশনটা গানটার ফ্রেমটাকে বিশাল করে ফেলেছে, বিশাল হয়ে গিয়েছে গানটা । মনে হচ্ছে অনেক কিছু হচ্ছে। তবে কোক স্টুডিওর আগের কিছু গানে ফিউশনের ব্যাপারটা এই গানে নেই । কম্পোজ করার সময় যথেষ্ট যত্ন করা হয়েছে যাতে মোডের বাইরে না চলে যায় । মোটেও কমার্শিয়াল মনে হয়নি । অরিজানিলিটিতে কোন সমস্যা হয়নি । বাবনার গলায় চমৎকার লেগেছে গানটা, মনে হয়েছে এই গানটা ওর গলার জন্যেই তৈরি হয়েছে। As a composer বলতে পারি যে গানটা মুনা ভাই গাইলেও চমৎকার লাগতো । হয়তো এমন হতে পারে যে বাবনা এবং মুনা ভাইয়ের গলার কোন একটা ফ্রিকোয়েন্সি বা গায়কী স্টাইলের কোন একটা জায়গা একই রকমের ।
আশিকুজ্জামান টুলু
যারা মেনে নিতে পারেনি নতুন কম্পোজিশন, তারা ওয়ারফেইজের এতই অন্ধ ভক্ত যে ওরা চিন্তাও করতে পারেনা নতুন করে এই গানটার সর্বনাশ অন্য কেউ করবে । ওদের দোষ না, এটা একটা মায়া, একটা ভালোবাসা, একটা অভিমান । বাবা মা যেমন নিজের সন্তানকে চায়না অন্য কোথাও যাক, তারা চায় সন্তান তাদের বুকে বুকে থাকুক । কিন্তু একসময় বড় কোন প্রয়োজনের কারনে সন্তানকে চলে যেতে হয় । কথাটা এই কারনে বললামঃ গান একদল মেঘের মতো, একবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলে ও উড়ে যায় আকাশে, আর কোন দিনও তাকে ফেরত আনা যায়না । এই উড়ে যাওয়ার পর কিছু সময় থাকে তোমার আকাশে, তারপর উড়ে চলে যায় অন্য কারও আকাশে । তুমি যেই সুখের চোখে মেঘকে দেখেছো, ও হয়তবা অন্য এক দুঃখের চোখে একই মেঘকে দেখছে । আজ থেকে ২০ বছর আগে যেই গানকে তুমি যেভাবে ভালবেসেছিলে, সেই গান এখন চলে এসেছে নতুন প্রজন্মের কাছে, ওরা হয়তবা তোমার শোনা ঐ কম্পোজিশনে গানটা পছন্দ না করে নতুন কম্পোজিশনে শুনতে বেশী পছন্দ করছে । তাতে কি কোন ক্ষতি আছে?? নেই, কোন ক্ষতি নেই, কারন গান তো একই আছে, শুধু পরিবেশনায় এসেছে নতুন ধারা । কি করবে তুমি? তুমি তো পুরনো হয়ে গিয়েছো, এখন তো নতুনকে শোনার জায়গা করে দিতে হবে । স্বাধীন করে দাও তোমার প্রেমিকা গানটাকে, ও ভেসে বেড়াক অনেকের আকাশে, কি ক্ষতি তাতে । এখন তো এই গান আর ওয়ারফেইজেরও না, এখন এটা হয়ে গিয়েছে সাড়া পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের । কথায় আছে, ভালবাসলে ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে ভালোবাসা আরও বাড়ে । তোমার শোনা অবাক ভালোবাসা তো কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা । ওটাকে তোমার মনের কোনে সযত্নে রেখে দাও যুগ যুগ ধরে, আর নতুনটাকে ছেড়ে দাও নতুনদের জন্য । ওরাও নতুন করে হারাক অবাক ভালোবাসায় ।
আর যারা নকল বলে, ওদের কথা বলে লাভ নাই, ওরা অ্যাটেনশন চায় । দুই কোটি মানুষের পছন্দের মধ্যে যদি ১৩ জন নকল বলে, তাতে কিই বা এসে যায় । ওরা তো জীবনে ঐ নকলটাও সৃষ্টি করতে পারেনি বিধায় ফ্রাস্টেটেড, ওদের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখো কারন ওরা কোনদিনও কোন সৃষ্টির আনন্দটা উপলব্ধি করতে পারেনা এই নকল ধরতে গিয়ে, তাই ওদের মনটা সবসময় নেগেটিভ হয়ে থাকে । ওরা আসলে বি এস টি আই এ চাকরী পেলে খুব উন্নতি করতো ।
আবার ফিরে আসি অবাক ভালোবাসার নতুন কম্পোজিশনের বিষয়টায় । একটা ছোট্ট উদাহরন দেই, আমার অসম্ভব প্রিয় গান All by myself. এটা যখন 70s এ করা হয়েছিল, গানটা সেই রকম কোর অরগানিক ছিল, একেবারে raw ব্যাপারটা গানকে মুড়ে রেখেছিল । গেয়েছিল Eric Carmen. তখনকারটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল । তারপর যখন নাইTটিজে David Foster আবার নতুন করে কম্পোজ করলো Celine Dion এর জন্য, গানটা শুনে আমি উড়ে গেলাম । গানটার ফ্রেমটা যে কত বড় হয়ে গেল তা আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না । বিশাল একটা আকাশ হয়ে গেল গানটা । গান দুইটার লিঙ্ক দিলাম, একটু শুনে দেখো । চোখ বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে বসে রাতের বেলায় শুনতে চেষ্টা কোরো ।
পুরনোটাঃ https://www.youtube.com/watch?v=iN9CjAfo5n0
নতুনটাঃ https://www.youtube.com/watch?v=NGrLb6W5YOM
আমি অন্যের ব্যাপারে জানিনা, আমার কাছে নতুন কিছু আসলে আমি শুনি ওপেন মাইন্ড নিয়ে এবং মন দিয়ে । হয়তবা নতুনকে গ্রহন করে নেওয়ার ইচ্ছা এবং আগ্রহই আমাকে পুরনোকে নতুন মোড়কে ভালবাসতে সাহায্য করে যদি তা পরিমিতি ও রুচিবোধের বাইরে না যায় । যাইহোক আমার কেন ভালো লেগেছে, সেটাই বিশ্লেষণ করলাম । তাই বলি ভালোলাগা যার যার, আর গান সবার ।