কিংবদন্তি শবনম
সময়টা ১৯৫৮ সাল। ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায় আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে নাচ পরিবেশন করেন তেরো বছরের কিশোরী ঝর্ণা বসাক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক এহতেশাম, যিনি ঝর্ণার বাবা ননী বসাকের বন্ধু।
আরও পড়ুন: আমাদের শবনম: যার ফিরে আসায় ধস নামে পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে!
বন্ধুর মেয়ের নাচের প্রতি মুগ্ধ হয়েই এহতেশাম তার ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিতে একটি দলীয় নাচের দৃশ্যে ঝর্ণাকে নেন। পরের ছবি ‘রাজধানীর বুকে’ও একটি গানের দৃশ্যে এ কিশোরীকে অংশগ্রহণ করান। তবে সামান্য সেই দৃশ্যে অংশগ্রহণ করলেও এহতেশাম নাম বদলে ফেলে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন শবনম নামে। কে জানতো সামান্য এই নাচের শিল্পী অভিনয়ে একদিন নাম লিখাবেন কিংবদন্তির খাতায়!
হ্যাঁ, বাংলা ও উর্দু ছবির কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনমের কথা বলছি। তার জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায়। তারা ছিলেন দুই বোন, বড় বোন নন্দিতা বসাক ও ছোট ঝর্ণা।বাবা ননী বসাক ছিলেন ফুটবল রেফারি ও মা উষা রানী গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই শবনম ছিলেন অসম্ভব চঞ্চল প্রকৃতির। মেয়ে হলেও তার পছন্দের খেলা ছিল ডাঙ্গুলি, ঘুড়ি উড়ানো ও রাস্তার পাশে মার্বেল খেলা।
খেলাধুলার পাশাপাশি নাচের প্রতি এক ধরনের আগ্রহ ছিল তার, সেই হিসেবে মাত্র ৪-৫ বয়সে বাড়িতে নাচের শিক্ষকও রেখে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: মেরা নাম শবনম : পাকিস্তানি সিনেমার বাঙালি সুপারস্টার!
শবনমের স্কুল জীবন শুরু হয় কলকাতায়। ১৯৫০ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে শবনমের পুরো পরিবার চলে যায় কলকাতায়। সেখানেই স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয় শবনমকে, পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে তারা আবার ফিরে আসেন ঢাকাতে, থাকতেন মদনমোহন রোডের নানার বাড়িতে। ঢাকায় আসার পর ভর্তি হন হাটখোলা নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং নাচের জন্য ভর্তি হন সদরঘাটের বুলবুল ললিতকলা একাডেমি তথা বাফায়।
শবনমের নানারা ছিলেন গোড়া হিন্দু পরিবার, বেশ রক্ষণশীলভাবে বাড়ির মেয়েদের থাকতে হতো। এ রকম একটি পরিবার থেকে মেয়েদের স্কুলে পড়ার অনুমতি থাকলেও নাচের জন্য কোন ছাড় ছিল না। তাইতো শবনমকে নাচ শিখতে হয়েছিল লুকিয়ে লুকিয়ে। তবে যেদিন শবনম একক নায়িকা হিসেবে ‘হারানো দিন’ (০৪/০৮/১৯৬১) ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হন সেদিনই তার নানা-মামারা ব্যাপারটি জেনে যান এবং তাদের বাসা থেকে এক প্রকার বের করে দেন, সেটা ১৯৬০ সালের কথা।
শবনম যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী তখন তার ‘এ দেশ তোমার আমার’ (২৫/১২/১৯৫৯), ‘আযান’ (উর্দু), ‘রাজধানীর বুকে’ (০২/০৯/১৯৬০) মুক্তি পেলে স্কুলের মেয়েরাও তাকে টিটকারি করতে থাকে। এক সময় এমন অবস্থা হলো তার স্কুলেই যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেল। পড়াশোনার ইতি সেখানেই করতে হলো তাকে, তবে অন্যদিকে খুলে গেলে তার চলচ্চিত্রের দুয়ার। ‘হারানো দিন’ সুপারহিট ব্যবসা করার পর শবনমের নাম ডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই শুরু… পরবর্তীতে তাকে আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
আরও পড়ুন: আমাদের নায়িকারা : শবনম
‘হারানো দিন’ সফল হওয়ার পরপরই এহতেশাম নির্মাণ করেন উর্দু ছবি ‘চান্দা’। যেখানে উর্দু ভাষা শিখতে রীতিমতো ঘাম ছোটাতে হয়েছিল শবনমকে। তখন আজকের মতো একজনের ডাবিং আরেকজনকে দিয়ে করানো হতো না, যার ডাবিং তাকেই করতে হতো। সেই হিসেবে মাত্র বাইশ দিনে উর্দু ভাষা শিখে তাকে ‘চান্দা’র জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। ‘চান্দা’ (০৩/০৮/১৯৬২) মুক্তির পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বাম্পার হিট ব্যবসা করে। ছবিটিতে চমৎকার অভিনয়ের গুনে শবনম প্রথম নিগার পুরস্কার পান।
এরপর একে একে ‘তালাশ’ (০৩/০৫/১৯৬৩), ‘প্রীত না জানে রীত’ (০১/১১/১৯৬৩), ‘তানহা’ (২৯/০৫/১৯৬৪), ‘পঁয়সে’ (২৮/০৮/১৯৬৪), ‘তুম মেরে হো’ (২৬/০৪/১৯৮৮)-সহ বেশ কিছু উর্দু ছবিতে অভিনয় করেন। এ সব ছবির সাফল্যে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শবনমের দিনদিন চাহিদা বাড়তে থাকে। সে হিসেবে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শবনম মাত্র সাতটি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন, অপরদিকে উর্দু ছবি করেন ষোলোটি।
শবনম যখন ক্যারিয়ার গড়তে একনিষ্ঠভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তখন বিয়ে করে বসেন সুরকার রবীন ঘোষকে। রবীন ছিলেন সে সময়ের বেশ নাম ডাকওয়ালা একজন সংগীত পরিচালক। ক্যারিয়ারের শুরুতে বিয়ে নিয়ে তখনকার সিনে পত্রিকাতে লেখা হয়েছিল, ‘তবে কি শবনম এবার সিনেমায় ইতি টানবেন’। তবে পত্রিকার সেই খবরকে মিথ্যা প্রমাণিত করে শবনম এগিয়ে যেতে থাকলেন আরও দুর্বার গতিতে। এ দিকে উর্দু ছবিতে শবনমের তুমুল চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রবীন ঘোষকে নিয়ে লাহোরে চলে যান এবং সেখানেই গড়ে তোলেন সফল এক ক্যারিয়ার।
আরও পড়ুন: উর্দু সিনেমায় বাঙালিদের অবদান যেভাবে ভুলে গেছে পাকিস্তান
লাহোরে থাকাকালে শবনম তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেন। নায়ক হিসেবে কাজ করেন নাদিম, ওয়াহিদ মুরাদ, এজাজ, মোহাম্মদ আলী, কামাল, জাভেদ শেখসহ আরও অনেকের সঙ্গে। এত ছবির ভিড়ে ১৯৭২ সালে নির্মিত শবনম, নাদিম ও শাহেদ অভিনীত ‘জিনাত’ উল্লেখ্যযোগ্য ছবি হিসেবে এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে। ছবিটি নাকি এখনো পাকিস্তানি ফিল্ম হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি হিসেবে মর্যাদা ধরে আছে।
জানা যায়, সত্তর দশকে শবনমের এতটাই জনপ্রিয়তা ছিল যে পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রদেশের প্রতিটি সিনেমা হলে শবনমের ছবি প্রদর্শিত হতো ‘শবনম উইক’ নাম দিয়ে। এ ছাড়া পাকিস্তানের চলচ্চিত্র ইতিহাসে শবনম একমাত্র অভিনেত্রী যিনি মোট বারোবার ‘নিগার’ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তবে ১৯৭৮ সালে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর শবনম সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশে ফিরে আসার।
আশির দশকে স্বামী রবীন ঘোষকে নিয়ে নিজ দেশ চলে আসেন শবনম। তাদের একমাত্র ছেলে বর্তমানে লন্ডনে স্থায়ীভাবে আছেন।
শবনম বাংলাদেশে আসার পর অভিনয় থেকে কিছুদিন দুরে থাকলেও ঢাকাই ছবিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন। ওই সময় গাজী মাজহারুল আনোয়ারে পরিচালনায় ‘সন্ধি’ দিয়ে ঢাকাই ছবিতে নিয়মিত হন। তিনি বাংলাদেশের তিনি মোট ৪৪টি ছবিতে অভিনয় করেন, সর্বশেষটি ছিল কাজী হায়াৎ পরিচালিত বিখ্যাত ‘আম্মাজান’ (২৫/০৬/১৯৯৯)।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানের সিনেমা শিল্প যা হারিয়েছে
পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে শবনম অভিনীত উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্র: হারানো দিন (০৪/০৮/১৯৬১), নতুন দিগন্ত (০৩/০৫/১৯৬৮), জোয়ার ভাটা (১৯/০৯/১৯৬৯), নাচের পুতুল (০৮/০১/১৯৭১), সন্ধি (২৯/০৫/১৯৮৭), জুলি (০৩/০৭/১৯৮৭), যোগাযোগ (০৮/০৪/১৯৮৮), শর্ত (০৬/১০/১৯৮৯), সহধর্মিনী (০৬/১০/১৯৮৯), ভালোবাসা ভালোবাসা (২৩/০২/১৯৯০), কারণ (০৭/০৯/১৯৯০), বিশাল (৩১/০৫/১৯৯১), লেডি কমান্ডো (২৭/১২/১৯৯১), দিল (২২/০৫/১৯৯২), সম্পর্ক (০৬/১১/১৯৯২), প্রেম শক্তি (২৫/০৩/১৯৯৩) ও আম্মাজান (২৫/০৫/১৯৯৯)।