গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দিয়ে শুরু ‘৩৬-২৪-৩৬’
চারদিকটা কেমন যেন। আর যাই হোক, দেশের মানুষ এখন সিনেমা দেখার আবহে নেই। তাই বলে কোনো কিছু থেমেও তো নেই। ওই যে, বলে- ‘দেখানো অবশ্যই জারি থাকবে’। থমথমে এই পরিস্থিতিতে সিনেমা মুক্তির ঘোষণায় অবাক হলাম! অবাক হলাম বলেই মনে হলো সিনেমাটা দেখা জরুরী। জরুরী দুকলম লেখাও। প্রতিকূলে সাঁতরানোর সাহস যার আছে; তার পাশে দাঁড়ানোর সাহসও আমাকে দেখাতে হবে।
সম্ভবত বছরের দ্বিতীয় বাংলা সিনেমা দেখতে চলে গেলাম এসকে টাওয়ার মহাখালী- চরকি প্রযোজিত, দীঘি অভিনীত মিনিস্ট্রি অব লাভ সিরিজের পঞ্চম সিনেমা ‘৩৬-২৪-৩৬’ এর প্রিমিয়ারে। পরিচালক রেজাউর রহমানের প্রথম ছবি। এর আগে তার ওয়েব সিরিজ ‘ইন্টার্নশিপ’ দেখেছি।
‘ইন্টার্নশিপ’ দেখে সিরিজটি নিয়ে লেখার তাগিদ অনুভব করেছিলাম ভেতর থেকে। সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কম প্রচলিত শিল্পীদের দিয়ে যুতসই অভিনয় বের করে আনা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে যথাযথ ‘চিকিৎসা’ দিয়ে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা, আবহসঙ্গীতের সুচিন্তিত ব্যাবহার, গল্পের ভিন্নতা এবং হিউমার করতে পারাটা ছিল রেজাউর রহমানের মুনশিয়ানা। ‘ইন্টার্নশিপ’ যারা দেখেন নাই দেখে নিতে পারেন। তবে বিজ্ঞাপন এজেন্সি কিংবা ক্রিয়েটিভ সেক্টরের বাইরের মানুষ মজা নাও পেতে পারেন।
আমি জানতাম না, ‘৩৬-২৪-৩৬’ এর নির্মাতা আর ইন্টার্নশিপ এর নির্মাতা একই ব্যক্তি। কিন্তু ‘৩৬-২৪-৩৬’ শুরু হওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কেন যেন মনে হলো। গুগল করে নিশ্চিত হলাম দুইটা প্রোডাকশনের নির্মাতা একজনই। বিষয়টা আলাদাভাবে উল্লেখ করার মতো। একজন নির্মাতার দুইটা কাজ দেখেই যখন তার ক্যামেরা টোন, সংলাপ, আবহসঙ্গীত কিংবা থিম দর্শকের কাছে আলাদা করে ধরা দেয়, বুঝতে হবে সেই নির্মাতা লম্বা ভ্রমণ করতেই ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছেন। সে ক্ষেত্রে নির্মাতা যদি গল্পের বিষয় নির্বাচনে আরও বড় জনগোষ্ঠির আবেগকে গুরুত্ব দিতে পারেন তার দৌড় সহসা শেষ হবে না।
গল্প
‘৩৬-২৪-৩৬’ সিনেমার গল্পটা আমাদের সময়কার। সুদর্শন এক যুবক প্রচুর অ্যাফোর্ট দিয়ে একটা অনলাইন পেজের অ্যাডমিন ও মালিককে পটানোর চেষ্টা করে। মেয়েটা পটতে চায় না; কারণ, তার ওজন বেশি। মেয়েটার আশঙ্কা, সামনে থেকে দেখলে সুদর্শন যুবকের মনে প্রেমটা থাকবে না। কেটে যাবে মোহ। সামনে চলে আসবে বডি শেমিং। তার আত্মবিশ্বাসের পারদ আরও নিচে নামবে। কী দরকার। ছেলেটা নাছোড় বান্দা। দেখা করবেই। ফ্লার্টিংয়ের সর্বোচ্চ স্কিল ব্যবহার করে দেখা করে। তারা দারুণ একটা দিন কাটায়। মেয়েটার মনে হতে থাকে, সবাই এক না। কেউ কেউ ভালো হয়।
রফুরে দিন কাটিয়ে মেয়েটা বাসায় ফেরে। এরপর থেকেই ছেলেটার নাম্বার বন্ধ। ফেসবুকে ব্লক। যোগাযোগের সব রাস্তায় বন্ধ করে রেখেছে। মেয়েটা কষ্ট পায়। আবার বাস্তবতা মেনেও নেয়। সে বুঝতে পারে, তার শারীরিক গড়নের কারণে ছেলেটা চাইছে না যোগাযোগ করতে। ঝামেলা পাকায় মেয়েটার বান্ধবী। বান্ধবী ছেলেটার সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে জানতে পারে, সে ক্যান্সারে আক্রান্ত। লাস্ট স্টেজে আছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়া হয়েছে।
দেখা হওয়ার পরদিনই জলজ্যান্ত একটা মানুষের এত বড় অসুখ ধরা পড়ায় মেয়েটা নিজেকে অপয়া ভাবতে শুরু করে। তার মতো করে দোয়া দরুদ আর টেনশন চালিয়ে যায়। খুব দ্রুত মেয়েটা জানতে পারে ছেলেটা মারা গেছে। বন্ধু মেয়েটাকে সুদর্শন ছেলেটার কবরেও নিয়ে যায়। একটা ছেলে তার জীবনে এলো, স্পেশাল ফিল করাল, তার পরই হুট করে মারা গেল… মেয়েটা এই ট্রমা থেকে বের হবে কিভাবে? কিংবা এর পরেই বা গল্প কোন দিকে যাবে? সিনেমা শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দর্শকের মাথায় ঢুকিয়ে দেন নির্মাতা।
অভিনয়
সিনেমার প্রতিটি চরিত্র গল্পটাকে আপন করে নিয়েছেন। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। না আছে অতিঅভিনয়, না আছে অঅভিনয়। ফলে কোথাও মনে হয়নি তারা অভিনয় করছেন। এর পেছনে চরিত্র বাছাইকারীকে আলাদা করে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ, গল্প যে সোসাইটিকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে, নির্মাণের ক্ষেত্রে সেই সোসাইটিতে বিলং করা শিল্পীদেরই নেওয়া হয়েছে।
সিনেমায় দীঘির চরিত্রটা বড়লোকের আদুরে মেয়ে; যে তার বিয়ে নিয়ে প্রচণ্ড এক্সাইটেড। দীঘির চোখ ও শারীরি ভাষায় চরিত্র ফুটে উঠেছে দুর্দান্তভাবে। এই প্রথম হয়তো দর্শক দীঘিকে অভিনয়ে পূর্ণ মার্ক দেওয়ার জায়গা পাবেন। একইভাবে শাওন, কারিনা কায়সার, তানভীর, মিলি বাশারদের অভিনয়ে মনে হয়েছে তাদের যাপিত জীবনের অংশ তুলে আনা হয়েছে ক্যামেরায়। প্রত্যেকের অভিনয় ছিল সাবলীল, চোখের আরাম জাগানিয়া।
কাদের জন্য এই সিনেমা
নির্মাতা ও শিল্পীরা বলে থাকেন, সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য এই সিনেমা। ‘৩৬-২৪-৩৬’ সিনেমার কলাকুশলীরা এমন কথা বলেছেন কি না আমার জানা নেই। আমার মনে হয়েছে তাদের এই কথা বলার সুযোগও নেই। গল্পের বিষয়, চরিত্রদের সংলাপ এবং অন্যান্য দিক দেখে মনে হয় না সমাজের সকল স্তরের মানুষ সিনেমাটি দেখে মজা পাবেন কিংবা ম্যাসেজ ধরতে পারবেন। উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির দর্শককে টার্গেট করেই হয়তো লেখা হয়েছে, বানানো হয়েছে। তবে সিনেমায় দেখানো বিষয়টি সব শ্রেণিতেই ঘটে। কেউ যদি তার মতো করে বুঝে নিতে পারেন, সব শ্রেণির মানুষই সিনেমাটা দেখতে পারবেন, নিজেকে খুঁজে নিতে পারবেন।
কমেডি
কমেডি রোমান্টিক ঘরানার সিনেমা হলেও কমেডিটা ঠিকঠাক জমেছে বলে মনে হয়নি। হো হো করে হেসে ওঠার উপাদান পাওয়া যায়নি। যে কয় জায়গায় সংলাপে মজা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, শিক্ষিত শ্রেণির দর্শক মনে হয় না হাসার মতো কিছু পাবেন। অন্তত, মিম ট্রলের এই যুগে, ফেসবুকে জেনজিদের রাজত্বকালে আরও শক্ত কমিক এলিমেন্টস না থাকলে যে কোনো গল্পের জন্য কমেডি হয়ে ওঠা কঠিন। ‘৩৬-২৪-৩৬’ খুব কম ক্ষেত্রেই প্রাণ খুলে হাসাতে পেরেছে।
গান
সিনেমায় দুইটা গান ব্যবহৃত হয়েছে। গান দুটোয় চলমান বাংলা গানের সংকট প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। শাকিব খানের ‘ঈশ্বর’ গানের আগে পড়ে আমরা বাংলা সিনেমা থেকে শ্রুতিমধুর কথা নির্ভর গান পাইনি। গানের সুর, সংগীত সবই ঠিক আছে, কথাটা হয়ে উঠছে না। এই সিনেমার দুইটা গান শুনে ঠিক তেমনটাই আমার মনে হয়েছে। হলুদ হলুদ ড্যান্স শিরোনামে একটা গান আছে। আসন্ন শীতে হয়তো সব গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গানটা বাজবে। এই গানের কম্পোজ, অ্যারেঞ্জ সবই ভালো হয়েছে; শুধু লিরিকটাই কিছু হয়ে ওঠে নাই।
আবহসঙ্গীত
এই সিনেমার আবহসঙ্গীতে খুব বেশি ক্রিয়েটিভি দেখানোর জায়গা ছিল না হয়তো। সংগীত পরিচালক সেই চেষ্টাও করেননি। পরিমিত মিউজিক ব্যবহার করেছেন। যেখানে যা লেগেছে যাই দিয়েছেন। ফলে কোথাও আবহসঙ্গীতে ঘাটতি লাগেনি, আবার আলাদাভাবে মনে রাখার মতো কোনো সুর মিউজিকও কানে বাজেনি।
সবশেষে
সিনেমার নাম নিয়ে দর্শকের একটু খটকা লাগতে পারে। যেহেতু কোলকাতায় এই শিরোনামে একটা গান আছে, সিনেমাও আছে সম্ভবত। পাশের দেশে অনেক সিনেমায় ‘৩৬-২৪-৩৬’ সংলাপ ব্যবহার করা হয় মোটামুটি অশালীনভাবে। গল্পে নামকরণের সার্থকতা থাকলেও সার্থকতা ফুটিয়ে তোলার জোর জবরদস্তি প্রবণতা দেখাননি নির্মাতা। ফলে রূপক অর্থে নামটা যুতসই লেগেছে।
দেশের বেশ কয়েকটি হলে সিনেমাটা চলছে। প্রিয় পাঠক, আমার সমালোচনায় প্রভাবিত না হয়ে পরিবারের সাথে দেখে নিতে পারেন সিনেমাটা। বোরিং হবেন না অন্তত।