Select Page

চোখের সামনে ঘটে যাওয়া চলচ্চিত্র

চোখের সামনে ঘটে যাওয়া চলচ্চিত্র

আমগো হাওরের মানুষের একটাই স্বপন প্যাটটা ভইরা ভাত খাওয়া..

লেখাটা এ অসাধারণ সংলাপ দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। হাওর অঞ্চলের মানুষের সংলাপ হলেও বস্তুত সব শ্রেণির মানুষের সংগ্রামই আদতে এ সংলাপটি তুলে ধরে সবাই ভাতের জন্যই সংগ্রাম করে। পার্থক্যটা হচ্ছে হাওরের মানুষের সংগ্রামের ধরণটা বাকিদের থেকে একদম ভিন্ন। তাদের টিকেই থাকতে হয় প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের সেই বাস্তবতা পরিচালক মোহাম্মদ কাইউম ফ্রেমবন্দী করেছেন ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া‘ চলচ্চিত্রে। ছবির নির্মাণ এত ন্যাচারাল যে চোখের সামনেই সব ঘটে যাচ্ছে। ছবিটি পরিচালকের হাওরে অবস্থানরত ৩ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতার ফসল। ঋতু পরিবর্তনের বিষয়টি ধরতে তিনি সময় নিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।

সাধারণত দেখা যায় নদীকেন্দ্রিক ছবিগুলোতে সে নদীর নাম দিয়ে ছবির নাম রাখা হয়। নাম দিয়ে সহজে বোঝা যায় কোন জনপদের গল্প বলা হয়েছে কিন্তু এ ছবিতে নামটা রাখা হয়েছে অন্যভাবে। ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ পাখির প্রকৃতিতে টিকে থাকার সাথে মানুষের জীবন সংগ্রামকে তুলে ধরেছে। এটা একটা গভীর দৃষ্টিকোণ।

ছবিতে অভিনয় করা ছোট্ট মেয়ে শিশুশিল্পীটি ‘কুড়া পক্ষী’-র পরিচিতি দেয়। সে তার সাথীদের নিয়ে কুড়া পক্ষী দেখতে যায়। এ পাখি পোষও মানে সে বলে। নতুন পানি হাওরে এলে তারা ভিড় করে, ধানক্ষেতে পোক খায়, খুঁটিয়ে খায় ডিম পাড়ে।

হাওরের অঞ্চলের বাস্তবতার একটা উদাহরণ অশীতিপর বৃদ্ধ চরিত্রের অভিনেতা দেয়। তিনি এমনও দেখেছেন মানুষ কবর দেয়ার মতো মাটিও নেই যেদিকে চোখ যায় খালি পানি আর পানি শেষে সে লাশ ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না। কী সাংঘাতিক!

ছবির সংলাপের মধ্যে অশীতিপর বৃদ্ধের দুটি দীর্ঘ সংলাপই ছিল সেরা-

১.’এই দুনিয়ার মানুষ বড় বড় দালান বানাইয়া এটা ওটা বানাইয়া মালিক সাইজা বইসা আছে অথচ একটা ছোট্ট পিঁপড়া তারও হিস্যা আছে এ দুনিয়ায়, তার বাঁইচা থাকার হিস্যা কে দিব? মালিক সাজছে!

২. ধানক্ষেতে ছাতা মাথায় কে রে? চৈত মাসের রোদ সহ্য করে ধান পাকে। ধান যদি রোদ সহ্য করতে পারে তুমি পারতা না ক্যান?

দার্শনিকতা ভরা সংলাপ।

পানি যেন নিজেই একটি চরিত্র এ ছবির। কলকল করে সবসময় নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। কী নৌকার গায়ে, কী দাঁড়টানার সময়, কী ঘরের কাছে, কী ভাসতে থাকা হাঁসের গায়ে সবখানে পানির সদর্প ছুটে চলা। কুড়া পক্ষীর খুঁটে খাওয়া, দূরের পাহাড়, গাছের ঘন সারি, বীজতলা তৈরি ও রোয়া দেয়া, নতুন ধানের আগমন, ঋতু পরিবর্তন, মাকড়সার নতুন জাল বোনার সাথে দুর্যোগ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের দৃশ্যায়ন সব জীবন্ত।

সোনা বন্ধু রে

আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি,

গগনেতে ডাকে দেয়া

আসমান হইল আন্ধিরে বন্ধু

আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি।

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বিখ্যাত এ লোকসঙ্গীতের ব্যবহার হৃদয়গ্রাহী করে দেখানো হয়েছে ছবিতে। হাওরের সৌন্দর্যের সাথে গানও যেন সাঙ্গীতিক সৌন্দর্য পেয়েছে।

সাংস্কৃতিক দৃশ্যায়নও ছবিতে ভালোভাবে এসেছে। হাওরে ভেসে যাওয়া জাহাজে বিয়ের পার্টির নাচ আর আঞ্চলিক গান, মেয়েকে ঘুম দিতে নিজাম ডাকাতের কাহিনী শোনানো, অশীতিপর বৃদ্ধের লোকসঙ্গীত গাওয়া এগুলো দারুণ। বিয়ের গীত যারা অনেকদিন শোনে না ছবিতে এ দৃশ্য তাদের ভালো লাগবে। ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ফসলের সংযোগ অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি। ঈশান কোণে কালো মেঘ ঘন করে এলে ছোটবেলায় আমরা যেভাবে পালাতাম ছবিতে এমন দৃশ্যও শৈশবীয় সংস্কৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হবে।

ছবির প্রধান দুই চরিত্রে উজ্জ্বল কবির হিমু ও জয়িতা মহলানবিশ ন্যাচারাল অভিনয় করেছে। জয়িতা মহলানবিশ তো পরিচিত মুখ অভিনয়জগতের তার অভিনয় বরাবরই ন্যাচারাল অন্যদিকে উজ্জ্বল কবির হিমুর অভিনয় ভালোভাবেই নোটিশ করার মতো। মেয়ে শিশুশিল্পীর ন্যাচারাল অভিনয় আর হাসিও চোখে লেগে থাকার মতো। অশীতিপর বৃদ্ধের অভিনয় বিশেষভাবে মনে রাখার মতো তার দার্শনিকতাপূর্ণ  সংলাপের জন্য। ছবির প্রথমার্ধ্ব ও দ্বিতীয়ার্ধ্বের মধ্যে গল্পের বৈচিত্র্য আছে। একদিকে নদী খাল হয়ে গেছে অন্যদিকে হাওরে সাগরসমান পানি একদিকে অপূর্ণতা তো আরেকদিকে পূর্ণতা এটা ছিল ছবির অসাধারণ একটা দৃশ্যায়ন। আনন্দ-বেদনার সমান্তরাল ঐক্যও ছবিতে আছে।

ছবির একটা দৃশ্য চোখে লেগে থাকে। রাতে হাওরের উথাল পাতাল পানিতে ভাসা নৌকায় একজন ঘুমিয়ে আছে। যে কোনো সময় মানুষটা ভেসে যেতে পারে পানিতে। এমন একটা দৃশ্য থেকেও বোঝা যায় কী পরিমাণ প্রতিকূলতা নিয়ে বাঁচে হাওরের মানুষ!

২০২২ সালের ছবির মধ্যে নির্মাণগুণে এটাই এখন পর্যন্ত সেরা ছবি।

রেটিং – ৮.৫/১০


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply