Select Page

নো ল্যান্ডস ম্যান: মিথ্যা ও রূপকথার প্রয়োজন রয়েছে

নো ল্যান্ডস ম্যান: মিথ্যা ও রূপকথার প্রয়োজন রয়েছে

(সম্প্রতি বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সর্বশেষ ছবি ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’-এর প্রিমিয়ার হয়েছে। ছবিটি নিয়ে এশিয়ান মুভি পালস সাইটে রিভিউ লিখেছেন পানোস কোৎজাথানাসিস। বাংলা মুভি ডেটাবেজের পাঠকদের জন্য রিভিউটি বাংলায় উপস্থাপন করা হলো।)

‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ ২০১৪ সালে মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা ও এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডস স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড জেতে এবং একই বছর এর পাণ্ডুলিপি ভারতে ফিল্ম বাজারে সেরা প্রজেক্ট নির্বাচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ছবিটি বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।

ছবির শুরুতে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় চরিত্র নবীন তার গার্লফ্রেন্ড ক্যাথিকে নিয়ে সিডনির একটি মেমোরিয়াল পার্কে গেছে। পার্ক ছেড়ে আসার আগে নবীন বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে ক্যাথিকে অপেক্ষা করতে বলে, কিন্তু সে আর ফিরে আসে না। ক্যাথি তাকে মরিয়া হয়ে সর্বত্র খুঁজতে শুরু করে এবং খোঁজার জন্য পুলিশের কাছে যায়। গল্প তখন অতীতে ফিরে যায়।

দুই বছর পূর্বে নবীন নিউ ইয়র্কে আসে এবং তার এক বন্ধুর সহায়তার একটি রেস্তোরাঁয় কাজ পায়। দুই বন্ধু এক সঙ্গে একটি অ্যাপার্টমেন্ট থাকে। সেখানেই ক্যাথির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। প্রাচ্যের নাক চ্যাপ্টা তরুণীটিও তাকে পছন্দ করে। তাদের সম্পর্ক উত্থান-পতন দেখা যায়, তথাপি নবীন বা সামির অনবরত মিথ্যা বলে, যা সামনেও আসে।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত চলচ্চিত্রটি থ্রিলার হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এটি নাটকীয়তায় রূপ নেয়, যেখানে একজন ব্যক্তি তার চারপাশে বিদ্যমান বর্ণবাদ থেকে বাঁচতে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়। নবীন সর্বত্রই মিথ্যা বলে এবং একপর্যায়ে এই মিথ্যা তার পরিচয় ভুলিয়ে দিতে বাধ্য করে। এমনকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেও নিজের সব মিথ্যার হিসাব রাখতে পারে না। ফারুকী নবীনের পরিচয়ের পূর্ণ সত্য উন্মোচনের জন্য ও মুসলিম হয়েও ভারতীয় হিন্দু বেশে নিউ ইয়র্কে অবস্থানের কারণ বের করতে যেভাবে মিথ্যার স্তর খুলতে থাকেন এবং যে উপাদানগুলো ছবিটিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় তা এই ছবির বর্ণনার অন্যতম সেরা অংশ।

এ ছাড়া গল্পটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুজন মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের যে যুক্তি উপস্থাপন করে তা বুদ্ধিদীপ্ত, যেখানে ক্যাথি মনে করে মিথ্যা বলাটা তেমন কিছু নয়, এবং তার বক্তব্য হলো প্রকৃতপক্ষে ‘পৃথিবীতে মিথ্যা ও রূপকথার প্রয়োজন রয়েছে’, যার মাধ্যমে বলা হয় যে, সত্যিকারের ভালোবাসা সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত মানসিক অবস্থান থেকে পাওয়া যায়।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ফারুকী যে রকম সূক্ষ্ম বর্ণনা তুলে ধরেছেন তা ছবিটি জুড়ে এর গল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফেরিতে নবীন সন্ত্রাসী হতে পারে এই ভেবে এক তরুণী ভীত, একজন ভিক্ষুক টাকা ফেলার জন্য ধর্মের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন পাত্র রেখেছে, প্রাচ্যের একটি মেয়ের কাগজের টুকরো, মার্কিন হিপ তরুণের মতো নবীনের পোশাক পরার চেষ্টা ও ক্লাবে নাচ, একটি যৌন দৃশ্যে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাল্পনিক উপস্থিতি ছবিটিতে দারুণভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে এবং পরিচালকের বুদ্ধিমত্তা ও সূক্ষ্ম হাস্যরসের বোধের মধ্য দিয়ে বিনোদন দিয়েছে। এই বোধ অন্য একটি দৃশ্যে শিখরে পৌঁছায় যখন নবীনের বন্ধু এই মিথ্যাকে চালিয়ে যেতে একজন অভিনেতাকে ভাড়া করে, যা সম্ভবত এই ছবির সবচেয়ে হাস্যরসাত্মক দৃশ্য।

তবে কয়েকটি জায়গায় ভুল ছিল। ছবিটিতে রহস্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাই খুব বেশি উল্লেখ করা যাবে না। সাবেক স্ত্রী সম্পর্কিত ধারণা, মূল সম্পর্ক যেভাবে এগিয়ে যায়, এবং সর্বোপরি সমাপ্তি আরেকটু ভালোভাবে পরিচালনা করা যেতো, কারণ নবীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাকিদের যোগসূত্র অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়েছে।

অন্যদিকে, গল্পটি একই দেশ, ধর্ম বা সম্প্রদায় থেকে শুরু করে সর্বস্তর থেকে আসা বর্ণবাদ বিষয়ে ফারুকীর মূল বক্তব্যকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতেও একই দক্ষতার প্রয়োগ দেখা যায়। এই দক্ষতার ফলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছেন নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকী, যিনি তার চরিত্রের বহু স্তর উপস্থাপন করেছেন। যারা এই ছবিটি দেখবে তাদের স্মৃতিতে সিদ্দিকীর নাইট ক্লাবের দৃশ্যটি রয়ে যাবে। ক্যাথি চরিত্রে মেগান মিচেল তার সেরাটা দিয়েছেন এবং তার অভিনয় যথেষ্ট ভালো, কিন্তু চলচ্চিত্রশিল্পের অন্যতম সেরা অভিনেতা সিদ্দিকীর পাশে তার দক্ষতার স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষণীয়।

আলেক্সেই কসোরুকভ ও শেখ রাজিবুল ইসলামের চিত্রগ্রহণে পারদর্শিতা দেখা যায়। তারা পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দৃশ্যপটের মধ্যে পার্থক্যগুলো বাস্তবসম্মত উপায়ে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। মোমিন বিশ্বাস সম্পাদনায় ফ্ল্যাশব্যাকগুলো বর্ণনার মধ্যে এমনভাবে এনেছেন যা খুবই সঙ্গত মিড-টেম্পোর সৃষ্টি করে। এ আর রহমানের সঙ্গীতও ফারুকী যেমনভাবে প্রতিটি দৃশ্য উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সেই নান্দনিকতা এবং অনুভূতি যুক্ত করে।

কয়েকটি জায়গায় লেখনীতে কিছু অসামঞ্জস্য এবং রোমান্স ও চরিত্রের গল্প কিছুটা অস্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও ফারুকী বিশ্লেষণধর্মী ও বিনোদনমূলক উপায়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে পেরেছেন। পাশাপাশি ছবিটির হাস্যরস ও অডিওভিজুয়াল সৌন্দর্যও উঁচুমানের।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

ব্লগার ও ডেটাবেজ এডিটর: বিএমডিবি

মন্তব্য করুন