ভেলকি লাগাল ‘আয়নাবাজি’
২০১৬ সালে বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে আয়নাবাজি ছিল সবচেয়ে প্রতীক্ষিত। তার কারণ অনেকগুলো। পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরীর কাছে দর্শকদের একটি ফিল্মের প্রত্যাশা ছিল বহু বছরের। অনেক অপেক্ষার পর তিনি সেই প্রত্যাশা পূরণ করছেন। অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী এর আরেকটি আকর্ষণ। তিনি ফিল্মে অভিনয়ের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। তার আগের সবক’টি ফিল্মে তিনি দর্শকদের চাহিদা পূর্ণ করেছেন। প্রথম দশকের ‘মনপুরা’ এখনো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি বিশাল মাইলস্টোন। এছাড়া রূপকথার গল্প, মনের মানুষ, টেলিভিশন সবকটিতেই চঞ্চলের অভিনয় নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। আয়নাবাজির ট্রেলার দর্শকদের মধ্যে মুগ্ধ বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল।
আয়নাবাজির মূল চরিত্র শরাফত করিম আয়না, ঢাকা শহরের এক নিঃসঙ্গ মানুষ। একা একা একটা চিলেকোঠা ঘরে থাকে আর মাঝে মাঝে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে। তার মা যাত্রাদলের অভিনেত্রী ছিলেন, আয়নাও অভিনেতা। তবে সে মঞ্চে বা নাটকে অভিনয় করে না, করে বাস্তব জগতে। নিজেকে বদলে ফেলে অন্য এক মানুষ হয়ে যায়। আয়না টাকার বিনিময়ে কোন না কোন অপরাধীর হয়ে জেল খেটে আসে। কিন্তু এমনভাবে সে নিজেকে চেহারায় ও আচরণে বদলে ফেলে যে, কেউ বুঝতে পারে না। একসময় তার জীবনে প্রেম আসে, সে অপরাধের জগত ছেড়ে স্বাভাবিক হওয়ার কথাও ভাবে। কিন্তু যে আয়নাকে সে নিজ হাতে তৈরি করেছে, সে তাকে মুক্তি দেয় না। বড় ধরণের একটা অপরাধের মামলায় বদলি হতে গিয়ে ফেঁসে যায় সে। তারপর মুক্তি কী পায়?
আয়নাবাজি চরিত্র নির্ভর গল্প। চঞ্চল চৌধুরীকে এখানে ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে। পরিচালক বলেছেন, এই চরিত্রটি করার জন্য বাংলাদেশে চঞ্চল চৌধুরী ছাড়া তার কাছে আর কোন বিকল্প ছিল না। আয়না নিজ চরিত্রে যখন থাকে তখন কিছুটা অন্তর্মুখী। যে চরিত্রগুলোর হয়ে আয়না জেল খেটেছে, তারা প্রত্যেকেই কমবেশি বহির্মুখী। ফলে তাদের চরিত্রগুলো নকল করা এবং দর্শককে বিশ্বাস করানো সম্ভব হয়েছে। একজন রাজনৈতিক নেতার চরিত্র ছিল, যেটি বহির্মুখী না হলেও তার কথা বলার, হাঁটার ও হাত নাড়ানোর বিশেষ ভঙ্গি ছিল।
মোটা দাগে চারভাবে একটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। আঙ্গিক বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে, বাচিক বা কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে, আহার্য বা পোশাক পরিচ্ছদের মাধ্যমে এবং সাত্তিক বা চরিত্রের সত্তাকে ভেতরে ধারণ করে। চঞ্চল চৌধুরী ছয়টি চরিত্রে এই সব ধরণের অভিনয় কলাই দেখিয়েছেন। আঙ্গিক অভিনয় ছিল ব্যবসায়ী, লাবু মিয়া এবং লাড্ডুর চরিত্রে। বাচিক অভিনয় ছিল নেতা নিজাম সায়ীদ চৌধুরী, লাড্ডু, ব্যবসায়ীর চরিত্রে। সাত্তিক অভিনয়ের ভালো উদাহরণ তৈরি হয়েছে ব্যবসায়ী ও নেতার চরিত্রে। চরিত্রের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমূলক কর্মকাণ্ডকে বিজনেস বলে। আয়নার যে চরিত্রগুলোই নকল করে তাদের প্রচুর বিজনেস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, এতে দর্শক হিসেবে আমরা সহজেই চরিত্রের নকল হয়ে যাওয়া টের পাই।
আয়নার পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি ছিল সাংবাদিক সাবের হোসেনের। সাবের হোসেন কর্মে এবং পারিবারিক জীবনে ব্যর্থ। রাগান্বিত এই মানুষটি নীতির সাথে আপোষ করতে না পেরে, কর্মে যোগ্য মূল্যায়ন পাননি। তবে আয়নার পেছনে একাগ্রতার সাথে পড়ে থেকে আয়নার সত্য আবিষ্কার করেন তিনি। ফলে শেষদিকে একটি বড় পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। পার্থ বড়ুয়া এই চরিত্রে বেশ মানানসই ছিলেন।
আয়নাবাজির নায়িকা চরিত্র কাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। হৃদি চরিত্রটি নির্মাতাদের আরও মনোযোগ পেতে পারত। তবে যেটুকু ছিল তা নাবিলা স্বচ্ছন্দেই রূপায়ণ করেছেন। হৃদি বেশ সাহসী মেয়ে। পছন্দের মানুষটির ব্যাপারে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে তার কোন সংকোচ ছিল না। দৈনন্দিন ব্যাপারেও সে ছিল সাবলীল। নাবিলা কোন চোখ ঝলসানো সাজে উপস্থিত হননি। কিন্তু একটা স্নিগ্ধতা আগাগোড়াই তার মধ্যে ছিল।
বৃন্দাবন দাশ করেছেন কারারক্ষী লাবু মিয়ার চরিত্র। সাদাসিধা লাবু মিয়া একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তার হাঁটার ধরণটিই পরে কাজে লেগে যায় আয়নার।
খাবারের দরকারি অংশ তার পুষ্টিগুণ, আর আকর্ষণীয় অংশ তার স্বাদ। তেমনি একটি গল্পের দরকারি উপাদান তার বুদ্ধিবৃত্তিক বা চেতনাগত অংশ, কিন্তু স্বাদের উপাদান তার হাস্যরস। আয়নাবাজিতে গল্পের ভেলকির পাশাপাশি হাস্যরসও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। কৌতুক দৃশ্য উপস্থাপনের জন্য দুজন অভিনেতা ছিলেন। একজন মিরাক্কেল খ্যাত জামিল, আরেকজন রবির বিখ্যাত বিজ্ঞাপন ‘সেইরাম ঠাণ্ডা’র শিশু শিল্পী। জামিলের প্রায় প্রতিটি ডায়ালগ ছিল হাসির। আর অন্য জন স্বল্প ডায়ালগে আর নানারকম কর্মকাণ্ডে যতক্ষণ উপস্থিত ছিল ততক্ষণই হাসিয়েছে।
সাংবাদিক সাবের হোসেন (পার্থ বড়ুয়া) আর আয়না যেখানেই মুখোমুখি হয়, সেখানেই আপনি হাসতে বাধ্য হবেন। সাংবাদিককে বিচিত্র সব উপায়ে বোকা বানিয়ে আয়না পাশ কাটায়। আয়না যখন নারী নির্যাতনকারী ব্যবসায়ীর চরিত্রে ঢুকছিল সে সময় তাদের কথোপকথন এবং অঙ্গভঙ্গিও ছিল হাস্যকর।
আয়নাবাজির গল্পের দাবি অনুযায়ী মেক আপ বা রূপসজ্জা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। আয়না যখন অন্য মানুষ হয়ে যায়, তখন বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নকল করার পাশাপাশি তাকে দেখতেও হুবুহু ঐ মানুষটির মত লাগতে হবে। চঞ্চল চৌধুরী আয়নাবাজিতে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন হুলিয়ায় ছিলেন। পশ্চিম বঙ্গের মেক আপ আর্টিস্ট মোহাম্মদ আলী এই বদলে ফেলার কাজটি যথেষ্ট সুন্দরভাবে করেছেন।
আয়নাবাজির একটা শক্তিশালী দিক হচ্ছে রাশেদ জামানের ক্যামেরা। চিরচেনা ঢাকা শহরকে তিনি নতুনভাবে দেখিয়েছেন। পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকাগুলো তার ক্যামেরার ভেতর অদ্ভুত রকমের মায়াময় দেখায়। এমনকি কাঁচা বাজার, মাছের বাজার, মুরগীর দোকানের দৃশ্য দেখে মনে হবে, এ কোথাকার বাজার, আগে তো দেখিনি। আয়না যে বাড়িতে থাকে, সেটাকেও তিনি নানা কোণ থেকে দেখিয়েছেন। সেট সুন্দর নির্বাচনের কারণে সুন্দরভাবে দেখানোও গেছে। কিছু ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শটে ঢাকা শহরকে দেখানো হয়েছে। কিছু কিছু শটে হেলিকপ্টার ভিউ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে শটগুলোকে কেন এভাবেই দেখানোর জন্য ভাবা হয়েছে, তা বোঝা যায়নি অনেকক্ষেত্রে। বুড়িগঙ্গা নদীকেও বিভিন্ন দৃশ্যে নানারকমভাবে দেখানো হয়েছে। আয়না হৃদির প্রেমের কিছু দৃশ্য ধরা হয়েছে নৌকায়। দূষিত বুড়িগঙ্গার এত সুন্দর চিত্রায়ন কিভাবে সম্ভব হল, সেটা রহস্যের মত লাগে। বৃষ্টি এবং বাতাসের দৃশ্য অমিতাভ রেজার বিজ্ঞাপন চিত্রে প্রাধান্য পায়। আয়নাবাজিতেও বৃষ্টির দৃশ্য অনেক যত্ন করে ধারণ করা হয়েছে। আয়না ও হৃদির চরম ভারাক্রান্ত মুহূর্তগুলোতে বৃষ্টিই ছিল দর্শকের কাছে বেদনা বর্ণনার বাহন। ক্যামেরার এধরনের কাজ বাংলা সিনেমার জন্য দৃষ্টান্তমূলক।
আয়নাবাজির কিছু বিশেষ বিশেষ সেটের কথা না বললেই নয়। আয়নার যে বাসায় থাকে সেটা দেখলেই আপনার ঐ বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে হবে। এক কামরার ঘর, চারপাশে খোলা জানালা, সাথে লাগোয়া ছাদ, ছাদের কোণায় স্নানের ব্যবস্থা, একপাশে রান্নাঘর। আয়না এক জায়গায় উল্লেখ করে, এটা নাকি হাওয়াঘর। এখানে হয়তো কোন তৈরি বাড়িকেই সেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু আয়নাবাজি টীমকে বাড়িটা খুঁজে বের করার কৃতিত্ব দিতেই হয়। আয়নার মহল্লায় একটা আলু পুরির দোকান ছিল, যেটা আয়নার হৃদির প্রেমে পড়ার অন্যতম ক্ষেত্র ছিল। দোকানের সেটটি সম্পূর্ণই সিনেমার উদ্দেশ্যে তৈরি করা।
জেলখানার দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে কাশিমপুর কারাগারে। পরিচালক উচ্ছ্বসিতভাবে কারাকর্তৃপক্ষের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। আর সত্যি কারাগারে শ্যুটিং করার কারণে দৃশ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। বিরতির পরে আয়নাকে একদল সন্ত্রাসী অপহরণ করে নির্মানাধীন বা ভগ্নস্তুপ এক দালানে নিয়ে যায়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আড্ডাখানা হিসেবে এমন স্থাপনাই উপযুক্ত।
ট্রেডিশানাল বাংলা ফিল্মে আবহ সঙ্গীত প্রায় উপেক্ষিত। গান গুরুত্ব পেলেও কোন একটি পরিস্থিতিকে ফুটিয়ে তুলতে আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার ততটা গুরুত্ব পায়নি। আয়নাবাজির একটি বাড়তি পাওয়া এর আবহ সঙ্গীত। পশ্চিমবঙ্গের ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত আগেই থ্রিলারধর্মী ফিল্ম বাইশে শ্রাবণের মিউজিক দিয়েছেন। আয়নাবাজিতেও তিনি জায়গায় জায়গায় মিউজিক্যাল থ্রিলিং মোমেন্ট তৈরি করেছেন। আয়না যখন নিজের চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যায়, সে মুহূর্তগুলোর শুরুতে সংলাপ থাকলেও শেষটা করা হয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে। মাঝে মাঝে কথাহীন সঙ্গীত সংলাপের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে যায়, তবে সেটা তৈরি করার দক্ষতাও থাকতে হয়। শেষ দৃশ্যে আয়নার পালানো এবং একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা হতে যাচ্ছে, এটা দেখানোর পুরো কাজটি করা হয়েছে প্রায় সংলাপহীন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে।
আয়নাবাজির গল্পপ্রধান ফিল্ম, গল্পের টুইস্ট এর প্রধান আকর্ষণ। গান ততটা চুম্বক অংশ ছিল না। তবে ফিল্মের শুরুই হয় অমিতাভ রেজার লেখা অর্ণবের গাওয়া ‘এই শহর আমার’ গান দিয়ে। তাতে আমরা বুঝতে পারি, এই শহরের গল্পই আমরা শুনতে যাচ্ছি। আয়নার কারাজীবনের গল্প শুনি চিরকুটের ‘পাপ জমাই’ গানে। পাপী আয়না তখন যার চরিত্র রূপায়ণ করছিল, নাচের মুদ্রাগুলোও দিচ্ছিল তার মত করেই। আয়না-হৃদির প্রেমের দিনগুলোকে দেখানো হয় ‘ধীরে ধীরে যাও না সময়’ গানে। আর ফিল্মের টাইটেল সং ‘লাগ ভেলকি লাগ’ যেন ফিল্মের পুরো অনুভূতিটাকেই ধরে আছে। আপনি যখন ফিল্ম দেখে হল থেকে বেরোবেন, তখন মাথায় এই গানটিই বাজতে থাকবে আর আপনি ভাবতে থাকবেন, এ কী ভেলকি দেখলাম রে বাবা!
আয়নাবাজির গল্পটি সৈয়দ গাউসুল আলম শাওনের। বাংলাদেশে এর আগে সাইকো থ্রিলার নির্মাণ হয়নি। সামজিক, রাজনৈতিক, রোমান্টিক, অ্যাকশান সব ধরণের ফিল্ম তৈরি হলেও থ্রিলারধর্মী ফিল্মের কাজ হয়নি। বাংলা সাহিত্যে থ্রিলারধর্মী অনেক গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। থ্রিলারের ফিল্মিং অনেক কঠিন একটি কাজ। পর্দায় টান টান উত্তেজনা ধরে রাখার উপস্থাপন কৌশল সহজ নয় মোটেই। আয়নাবাজির চিত্রনাট্য লিখেছেন অনম বিশ্বাস, আদনান আদীব খান এবং অমিতাভ রেজা চৌধুরী। সংলাপ লিখেছেন অনম বিশ্বাস এবং আদনান আদীব খান। ফিল্মে অনেক হাস্যরসাত্মক সংলাপ যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু চমকে দেওয়ার মত সংলাপ। কয়েকটি উল্লেখ করা যেতে পারে:
- মজা লাগে, ভোর হলে পরেই চরিত্র বদলাই। এক ক্যারেক্টার থেকে আরেক ক্যারেক্টারে শিফট হলেই সব হাওয়া।
- চারপাশ বদলে যায়, থেমে যায় সময়। মিথ্যা তখন সত্যি হয়।
- সবার জন্য সব সত্যি, আর আমার জন্য অভিনয়।
- রাজনীতি একটা অভিনয়। দেশ একটা মঞ্চ। সামনে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ জনতা।
- ফাঁসি আয়নাদেরই হয়।
তবে কিছু কিছু জায়গায় সংলাপ আরও মজবুত হওয়ার সুযোগ ছিল।
আয়নাবাজির চরিত্রগুলোর মধ্যে কেন্দ্রীয় চঞ্চল চৌধুরী। কিন্তু ফিল্মের কেন্দ্রীয় মানুষটি অমিতাভ রেজা চৌধুরী। অমিতাভ রেজার দীর্ঘ প্রস্তুতির ফসল আয়নাবাজি। তিনি প্রায় দশ বছর ধরে বিজ্ঞাপন নির্মাণের সাথে জড়িত। অনেক পরিচালক অনেক অল্প সময়েই ফিল্ম বানিয়ে মুক্তি দিয়েছেন। অমিতাভ রেজাকে আয়নাবাজি নির্মাণের জন্য প্রায় দেড় বছর ব্যয় করতে হয়েছে। এসময় তার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নির্মাণের কাজগুলো করেছেন তার সহকর্মীরা। যদিও ফিল্ম জগতে নতুন হওয়ার কারণে মাত্র ২০টি হল দিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে তাকে। ফিল্মের প্রতিটি অংশের জন্য তার চেষ্টা ছিল সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষটিকে নিযুক্ত করা। যেমন রূপসজ্জা আর আবহ সঙ্গীতের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের নিয়ে এসেছেন। প্রথম ছবি হিসেবে অনেকক্ষেত্রে অর্থ সংকট ছিল। অমিতাভ রেজার সাথে যাদের আগে থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল, তাদের অনেকেই কেবল ভাল একটি কাজের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য এসেছেন। অমিতাভ রেজার বক্তব্য অনুসারে অনেককেই তিনি পারিশ্রমিক হিসেবে কেবল একটা টোকেন মানি দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু অমিতাভ রেজার গ্রহণযোগ্যতার কারণে অনেকেই স্বল্প পারিশ্রমিকে কাজ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। পরিচালক হিসেবে এটা অনেক বড় সাফল্য।
বাংলা ছবির গতানুগতিক ধারায় না হেঁটে অনেকক্ষেত্রেই আয়নাবাজি নিজের পথ তৈরি করে নিয়েছে। আয়না আর হৃদির প্রেমের সূচনাই দেখানো হয়েছে সবজি বাজারে। প্রেমের দৃশ্য দেখানোর জন্য খুবই বিসদৃশ বা অভাবিতপূর্ব স্থান। নিঃসঙ্গ আয়না নিজের রান্না করত, মাঝে মাঝে ফোনে মায়ের সাথে কথা বলে ঠিক মায়ের রেসিপি মেনে রান্না করতে চেষ্টা করত সে। প্রথম দৃশ্যেই আমরা জানতে পারি, রান্নার ব্যাপারে আয়নার বিশেষ আগ্রহের কথা। আয়না সবাইকে বলত, সে জাহাজের বাবুর্চি। হৃদিরও রান্নার ব্যাপারে পারদর্শীতা ছিল। তাই উভয় মানব মানবী বাজারের ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী ছিল। সদৃশ মনের কারণে বিসদৃশ স্থান সত্ত্বেও কাছে আসা থেমে থাকেনি। প্রতিটি চরিত্রের জন্য জেল খাটার পর আয়না স্নান করত। হয়তোবা এটা ছিল তার শুদ্ধির প্রক্রিয়া। এমনই এক স্নানের মুহূর্তে তার সামনে নায়িকার উপস্থিতি তাকে বিব্রত করে। প্রথাগত সিনেমায় বিপরীতটাই দেখা যায়।
আয়নাবাজি যদিও অনেক যত্নে নির্মিত তবুও একে পুরোপুরি নিখুঁত বলা যাবে না। কিছু কিছু চরিত্রে অপেশাদার অভিনেতারা চরিত্রকে ঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। তাদের ডায়লগের ডেলিভারীতে অতিরঞ্জন ছিল। আয়না এবং হৃদির প্রেমে হয়ে যাওয়ার মত যথেষ্ট ঘটনা দেখানো হয়নি, যেন বা অজানা কারণে হৃদির একক আগ্রহে তাদের সম্পর্ক এগিয়ে গেছে। হৃদি আয়নার সব সত্য জানার পরে আয়না জেল থেকে ফিরে এলে হৃদি বিনা অভিমানে তাকে গ্রহণ করে নেয়। বিরতির পর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে অনেকটা সময় বেশ একঘেয়ে চলছিল, যেন নির্মাতার হাতে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পরে আয়নাকে অপহরণ করা হলে কাহিনী গতি পায়। আয়নাকে অপহরণের দৃশ্যে সন্ত্রাসীদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। হয়তো এর দৃশ্যায়নও ভিন্ন হতে পারত। পুলিশ ভ্যান থেকে অপরাধী বদলের দৃশ্যটি করা হয়েছে জনাকীর্ণ জায়গায়। পাকা অপরাধীরা এ ধরণের কাঁচা কাজ করত না বলেই ধারণা করি। সাংবাদিক সাবের হোসেনের ব্যক্তিগত জীবনের একটি অংশ দেখানো হয়েছে শুরুতে, কিন্তু তার কোন পরিণতি শেষ পর্যন্ত আর পাওয়া যায়নি। ফিল্মে আদালতের একটা দৃশ্য ছিল, সেটাও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়নি। আয়নাবাজির সবচেয়ে দুর্বল অংশ এর শেষ দৃশ্য। আয়না নিজের অভিনয় ও সম্মোহন দক্ষতা ব্যবহার করে জেল থেকে পালাতে পারে, এটা বিশ্বাস হলেও যেভাবে এর সম্পাদন দেখানো হয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। আয়না যা করেছে তা আইনের চোখে অপরাধ হলেও তার কোন শাস্তি দেখানো হয়নি। জেল খাটা তার সাজা হতে পারে না, কারণ জেল খাটাই ছিল তার অপরাধ। কেন্দ্রীয় চরিত্রকে অপরাধী দেখাতে হলে তার শাস্তি দেখানোটা জরুরি, না হলে তা সাধারণ মানুষকে ভুল শিক্ষা দেবে।
কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম শরাফত করিম আয়না, খুব সুচিন্তিতই মনে হয়। আয়না শরাফতের সাথে জীবন তো যাপন করেই না বরং নিজেকে বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ হয়ে যায়, যেন আয়নার প্রতিবিম্বের মত। তাই তার নাম আয়না হওয়াটাও মোক্ষম। আয়না যে ভেলকিবাজি দেখায় সেটাই আয়নাবাজি। তাই ‘লাগ ভেলকি লাগ’ গানটিই এই ফিল্মের টাইটেল সং হওয়ার যোগ্য। জমজমাট একটি কাহিনী নিয়ে অনেকদিন পর বাংলাদেশে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেল। এটি দর্শকদের আবারও হলমুখী করেছে। যে ক’টি হলেই আয়নাবাজি মুক্তি পেয়েছে সবগুলোতেই প্রথম শো থেকেই ভীড় লক্ষণীয় ছিল। সাধারণ মানুষকে গল্পের ধারণাটি চমকে দিয়েছে। বাংলাদেশের সিনেমায় এই ঘরানার ফিল্ম হিসেবেও এটি প্রথম। কিছু ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এটি বাংলাদেশের আরেকটি মাইলস্টোন হতে যাচ্ছে। আয়নাবাজি দলের সকলে এজন্য অভিনন্দনের যোগ্য হয়েছেন।
০৫/১০/২০১৬
শ্যামলী, ঢাকা।