সামাজিক-অ্যাকশন ধারার সাহসী নির্মাতা কাজী হায়াৎ
বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির ভক্ত কাছে খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম কাজী হায়াৎ। কারণ তিনিই সবচেয়ে বেশি রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনৈতিক অবক্ষয়গুলো তুলে ধরে সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন
পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা চলচ্চিত্র ১৯৫৬-৭১ সাল, এই ১৫ বছরে বিনোদনের প্রধান ও জনপ্রিয় একটি মাধ্যম হিসেবে জায়গা করে নেয়। তখন পর্যন্ত বাংলা-উর্দু মিলে যতগুলো ছবি মুক্তি পেয়েছিল তার মধ্যে রোমান্টিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ফোক ফ্যান্টাসি ছবি মুক্তি পেলেও একটি ছবিতেও ছিল না অ্যাকশন দৃশ্য। অথচ হিন্দি ও ইংরেজি ছবিতে তখন অ্যাকশন ধারা আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিল যার প্রভাব এসে পড়ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের ওপরও।
সেই না থাকার অভাব বুঝতে পেরেই প্রয়াত অভিনেতা ও পরিচালক জহিরুল হক তখনকার সুপারস্টার রাজ্জাক ও কবরীকে নিয়ে ‘রংবাজ’ শুরু করেন। যেখানে রাজ্জাক বস্তির একজন মাস্তান সে সবার প্রিয় ও সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। এমনই এক গল্পের মাধ্যমে জহিরুল হক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম অ্যাকশন দৃশ্য যুক্ত করেন। ‘রংবাজ’ ছবিতেই বাংলাদেশের দর্শক অ্যান্টিহিরো দেখতে পায়। ফলাফলে ছবিটি সুপারডুপার হিট।
সেই ১৯৭৩ সালে জহিরুল হকের মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক নীরব বিপ্লব এর সূচনা হয়; যার ফলে ধীরে ধীরে সামাজিক অ্যাকশন ছবির একটি শক্তিশালী ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখান থেকে আমরা পাই দেওয়ান নজরুল, আজিম, মাসুদ পারভেজ, আজিজুর রহমান, আজমল হুদা মিঠু, দিলীপ বিশ্বাস, অশোক ঘোষ, সিদ্দিক জামাল নান্টু, এ জে মিন্টু, কাজী হায়াৎ, ফজল আহমেদ বেনজির, মমতাজ আলী, মোতালেব হোসেন, হাফিজউদ্দিন, সাইফুল আজম কাশেম, কামাল আহমেদ , দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, দারাশিকো, আব্দুল লতিফ বাচ্চু, শিবলী সাদিক, শহীদুল ইসলাম খোকন, মালেক আফসারী, সোহানুর রহমান সোহান, রায়হান মুজিব, মনতাজুর রহমান আকবর, এফ আই মানিকের মতো অসংখ্য মেধাবী পরিচালকদের। যারা বাংলাদেশের বাণিজ্যিকধারার ছবিতে ৮০ ও ৯০ দশকে একটি এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটান। যার ফলে সেই সময় স্কুল পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী থেকে বৃদ্ধ বয়সের দর্শকসহ সবার মধ্য হলে সিনেমা দেখা একটা নেশায় পরিণত হয়।
৮০-৯০ দশক জুড়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অর্ধেকেরও বেশি আয় হতো এই সামাজিক অ্যাকশন ধারা থেকে। যার ফলে মূলধারার প্রায় সকল পরিচালকরা এ ধরনের ছবির প্রতি ঝুঁকতে বাধ্য হয়। প্রযোজকদেরও বেশি বেশি সামাজিক অ্যাকশন, রোমান্টিক অ্যাকশন ধারার ছবি নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হতে দেখা যায়।
এতে হাতে গোনা ২/১ জন ছাড়া অধিকাংশ প্রযোজক পরিচালক সফল হয়েছিলেন যাদের নাম ইতিহাসে ও দর্শকদের মনে চিরদিনের জন্য লেখা হয়ে গেছে। যা নিচে বিস্তারিতভাবে আমরা জানতে পারবো। সামাজিক অ্যাকশন ধারার ছবিগুলোর কিছু উল্লেখযোগ্য নাম— দোস্ত দুশমন, দোস্তি, বারুদ, গুনাহগার, মাসুদ রানা, জীবন নৌকা, মিন্টু আমার নাম, প্রতিজ্ঞা, ওস্তাদ সাগরেদ, চ্যালেঞ্জ, জনি, হুঁশিয়ার, তিন কন্যা, নীতিবান, নসীব, আদেশ, বদনসীব, নালিশ, লাওয়ারিশ, রকি, লড়াকু, জারকা, অস্বীকার, অপেক্ষা, রাম রহিম জন, রাস্তার রাজা, মাস্টার সামুরাই, অশান্তি, টাকা পয়সা, দেশ বিদেশ, ব্যবধান, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, দুনিয়া, বিরোধ, বীরপুরুষ, মারকশা, বিপ্লব, বজ্রমুষ্ঠী, সন্ধি, সন্ধান, যোগাযোগ, স্বাক্ষর, সারেন্ডার, হালচাল, লালু মাস্তান, হিরো, বিজয়, আক্রোশ, উসিলা, গর্জন, অর্জন, লড়াই, সম্পর্ক, বেনাম বাদশা, দাঙ্গা, ত্রাস, চাঁদাবাজ, সিপাহী, অপহরণ, লুটতরাজ ও আখেরি রাস্তা। এমন শত শত ছবির মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আজ যা শুধুই সোনালি অতীত ছাড়া কিছু নয়।
এ সময় সামাজিক অ্যাকশন ধারার ছবির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে পারভেজ ফিল্মস, জ্যাম্বস, জে কে মুভিজ, মেট্রো ফিল্মস, নানটু মুভিজ, এসএস প্রোডাকশন, সানফ্লাওয়ার মুভিজ, ভাই ভাই ফিল্মস, যমুনা ফিল্মস, মাসামো চলচ্চিত্র, বন্ধন বানীচিত্র, দেশ কথাচিত্রসহ অনেক জনপ্রিয় ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য প্রযোজনা সংস্থাগুলো।
বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির যারা ভক্ত কাছে খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম কাজী হায়াৎ। কারণ তিনিই সবচেয়ে বেশি রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনৈতিক অবক্ষয়গুলো তুলে ধরে সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন। তার ছবি মানেই ভিন্ন কিছু, রক্তে আগুন লাগা কিছু। কাজী হায়াৎ মানেই ‘অসৎ রাজনীতি’ ও ‘ভণ্ড দেশপ্রেমের’ বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে পুরো ছবিতে তুলাধুনো করা একজন পরিচালক। সমাজের অবক্ষয় ও জনদুর্ভোগ নিয়ে দেশে আর কোন পরিচালক সরাসরি এত বেশি চপেটাঘাত করেনি।
গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলা ফাকরা ইউনিয়নের তারাইল গ্রামে ১৯৪৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। কাজী হায়াৎ ১৯৭৪ সালে মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এবং ১৯৭৬-১৯৭৭ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিতেও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭৯ সালে ‘দি ফাদার’ পরিচালনার মধ্যে দিয়ে পূর্ণ-পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
কাজী হায়াৎ ছাত্রজীবন থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি এত বেশি আগ্রহী ছিলেন যে ১৯৭৪ সালেই মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই চলচ্চিত্রে মমতাজ আলী’র সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন । ‘দি ফাদার’ এর মতো শিল্পমান সম্মত ছবি দিয়ে পরিচালনা শুরু করলেও দ্বিতীয় ছবি ‘খোকন সোনা’ দিয়ে তিনি পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক নির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ‘দি ফাদার’ ঢাকা শহরে শিক্ষিত শ্রেণির কাছে প্রশংসা পেলেও গ্রামাঞ্চলসহ মফস্বল শহরে চলেনি, ফলে প্রযোজক ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোন। এ কারণে কাজী হায়াৎকে পরবর্তীতে অফিসে প্রবেশ করতে দেয়নি প্রযোজক। এই ঘটনার পরেই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে ছবি বানালে ব্যবসায়িক লাভের জন্যই বানাবেন এবং সেই বাণিজ্যিক ছবিতেই তিনি বক্তব্য তুলে ধরবেন।
কাজী হায়াতের ছবির মূল বৈশিষ্ট্য হলো— তিনি তৃণমূল থেকে সমাজের প্রতিটি শ্রেণির জনদুর্ভোগ, রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো তুলে ধরেন ১৯৯১ সালে ‘দাঙ্গা’ ছবিটি সারাদেশে আলোচিত হয়েছিল; কারণ তিনি অতি সাহসিকতার সঙ্গে একজন সংসদ সদস্য কীভাবে নিজের ক্ষমতার শক্তি দিয়ে একের পর এক অন্যায় করে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে ওঠেন তার চিত্র দেখিয়েছেন। এর পরপরই ‘ত্রাস’ ছবিতে মেধাবী ছাত্রদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কীভাবে ছাত্র রাজনীতির দোহাই দিয়ে অন্ধকার পথে ব্যবহার করছেন তার করুণচিত্র তুলে ধরেন।
‘দাঙ্গা’ ছবিতে প্রয়াত রাজীব সর্বপ্রথম শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন এবং দ্বিতীয়বার কাজী হায়াতেরই ‘চাঁদাবাজ’ ছবির খল চরিত্রের কারণে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন । ‘চাঁদাবাজ’ ছবিটি ছিল রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কীভাবে ‘চাঁদাবাজ’রা একটি মধ্যবিত্তে স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেন এবং সমাজে এদের প্রশ্রয়দাতা কারা সেই চিত্রনির্ভর। একইভাবে রাজনৈতিক কারণে কীভাবে মেধাবী নির্মাতার জীবনে তছনছ হয়ে যায় সেই সত্য ফুটিয়ে তোলেন ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিতে।
এ পর্যন্ত পঞ্চাশটি ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি— দি ফাদার, দিলদার আলী, খোকন সোনা, রাজবাড়ী, মনা পাগলা, পাগলী, বেরহম, আইন আদালত, দায়ী কে, যন্ত্রণা, দাঙ্গা, ত্রাস, দেশ প্রমিক, সিপাহী, পাগলা বাবুল, লাভ স্টোরী, চাঁদাবাজ, দেশদ্রোহী, তেজী, জবর দখল, লুটতরাজ, আম্মাজান, ধাওয়া, ধর, ঝড়, পাঞ্জা, আব্বাজান, সমাজকে বদলে দাও, তাণ্ডবলীলা, স্বপ্ন, কাবুলিওয়ালা, মিনিস্টার, কষ্ট, বর্তমান, ক্রোধ, ইতিহাস, অন্ধকার, অন্য মানুষ, ক্যাপ্টেন মারুফ, শ্রমিক নেতা, ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না, পিতা পুত্রের গল্প, মানিক রতন দুই ভাই, সর্বনাশা ইয়াবা, ইভটিজিং ও বীর।
কাজী হায়াৎ আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও অনন্য পুরস্কারসহ কমপক্ষে ৭৪টি স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এর মধ্যে চারটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ— ‘দায়ী কে’ নিয়ে কার্লোবিভেরী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব চেকোস্লোভাকিয়া (১৯৮৮), ‘যন্ত্রণা’র জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৮৯), ‘দাঙ্গা’ নিয়ে পিয়ং ইয়ং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৯১), ‘দাঙ্গা’ ও ‘চাঁদাবাজ’সহ তেহরান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ইরান (১৯৯২)। আন্তর্জাতিক সম্মাননা— পিয়ং ইয়ং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৯১), আফ্রো-এশিয়ো সলিডরি কমিটি অ্যাওয়ার্ড (১৯৯১)।
মোট আটটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান কাজী হায়াৎ। ‘দাঙ্গা’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। ‘দায়ী কে’ ছবির শ্রেষ্ঠ সংলাপের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ‘ত্রাস’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সংলাপ ও চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করেন। ‘চাঁদাবাজ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য ও কাহিনিকার, ‘দেশপ্রেমিক’-এর জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার এবং ‘ইতিহাস’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।