আসাদ একজনই
রাইসুল ইসলাম আসাদ… নামটাই যথেষ্ট। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আদর্শ অভিনেতা। এ নামটি আমাদের চলচ্চিত্র ও নাটক মাধ্যমকে সমৃদ্ধ করেছেন।
আসাদের জন্ম ঢাকায় ১৫ জুলাই ১৯৫৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
আসাদের অভিনয়ের গভীরতা প্রচণ্ড। মঞ্চের পেশাদার অভিনেতা। তাঁর প্রথম ছবি ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ১৯৭৩ সালে। বাণিজ্যিক ও অফট্র্যাক মিলিয়ে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন।
বাণিজ্যিকের মধ্যে আবার তোরা মানুষ হ, পদ্মানদীর মাঝি, নয়নের আলো, জ্যোতি, সুরুজ মিয়া, আয়না বিবির পালা, লাল সবুজের পালা’, পিতা মাতা সন্তান, প্রথম প্রেম, লাভ স্টোরি, রঙিন সুজন সখি, সত্যের মৃত্যু নেই, বিচার হবে, স্বপ্নের পৃথিবী, বুকের ভেতর আগুন, হঠাৎ বৃষ্টি, চুপি চুপি, ‘গহীন বালুচর‘ উল্লেখযোগ্য।
অফট্র্যাকের মধ্যে ‘ঘুড্ডি’, ‘অন্য জীবন’, ‘নদীর নাম মধুমতি’,‘দুখাই’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘লালসালু’, ‘আধিয়ার’, ‘লালন’, ‘এক খণ্ড জমি’,‘দূরত্ব’, ‘ঘানি’, ‘লিলিপুটেরা বড় হবে’, ‘মনের মানুষ’, ‘‘বিশ্বাস’, ‘খণ্ডগল্প ১৯৭১’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘মৃত্তিকা মায়া’, ‘আয়না জীবন’, ‘একই বৃত্তে’, ‘গাড়িওয়ালা’, ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে’, ‘আলতা বানু’, ও ‘কালের পুতুল’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘উত্তরা’, ও ‘লাল দরজা’ ছবিগুলো উল্লেখযোগ্য। ‘পতঙ্গ’ নামে একটি হিন্দি ছবিও করেছেন।
‘পদ্মানদীর মাঝি’ ছবি দিয়ে আসাদ লাইমলাইটে আসেন। জীবন্ত অভিনয় ছিল আসাদের। কুবের মাঝির বাস্তবতা আসাদ ফুটিয়ে তুলেছিল। কুবের চরিত্রটি তাঁর থেকে বেটার আর কেউ পারত না। ছবির গেটআপ নিতে গিয়ে তাঁকে সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। বাকিগুলোতে চরিত্র অনুযায়ী আসাদের পারফরম্যান্স ভালো ছিল। ‘আয়না বিবির পালা’ আর ‘সুরুজ মিয়া’ এ দুটোতে খলনায়ক ছিল। অমর নায়ক সালমান শাহ-র বেশকিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন আসাদ। ফেরদৌসের ক্যারিয়ারে প্রথমদিকের উল্লেখযোগ্য দুই ছবি ‘হঠাৎ বৃষ্টি, চুপি চুপি’-তে অভিনয় করেছেন।
অফট্র্যাকের আসাদ সবচেয়ে শক্তিশালী। ‘লাল সালু’ ধর্মীয় ব্যবসার বিরুদ্ধে গভীর প্রতিবাদ। এ ছবিতেও অভিনয়ের জন্য মজিদ চরিত্রে আসাদের বিকল্প ছিল না। তাঁর অভিনয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো আবহ ছিল।
‘দুখাই’ ছবি দেখে চোখ ভেজেনি বা মনটা কাঁদেনি এমন দর্শক পাওয়া মুশকিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলা এক মানুষ দুখাই। কালবৈশাখী ও বন্যায় স্ত্রী, সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। একটা বলদ দিয়ে হালচাষের সমস্যা তাই একদিকে নিজেই ধরে লাঙলের সাথে। ছবির অন্যতম সেরা দৃশ্য ছিল এটা। অসাধারণ জীবনমুখী ছবি।
কিত্তনখোলা, অন্যজীবন, লালন— এগুলোর কোনো তুলনা নাই। লালন শাহকে নির্মিত ছবির মধ্যে অন্যতম সেরা কাজ। তাঁর লালন গেটআপ তুলনাহীন আর অভিনয় ক্লাসিক।
‘ঘুড্ডি’ তো আধুনিকতার বিপরীতে একটা প্রমাণ সাইজের স্যাটায়ার। এই ছবিতে বাণিজ্যিক ছবির প্রচলিত হিরোইজমের বিরুদ্ধে স্যাটায়ার করা হয়েছে। ‘হিরো হইতেই হইব’ বলে লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের ভাষায় আসাদ এক বোহেমিয়ান যুবকের ভূমিকায় নায়ক হতে চান। তাঁর গেটআপ এ ছবিতে সব থেকে আলাদা ছিল। ‘ঘানি’ ও ‘মৃত্তিকা মায়া’ শেষের দিকের দুটি ক্লাসিক কাজ। ‘ঘানি’ ছবিতে ঘানি চালিয়ে তেল উৎপাদনের ফিনিশিং সিকোয়েন্সটি মর্মান্তিক ছিল।
আসাদের লিপে ‘ঘুড্ডি’ ছবির ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে’ হ্যাপি আখন্দের বিখ্যাত গান। এককালের ক্রেজ ছিল গানটি। গানে আসাদ, সুবর্ণার রসায়ন ও আধুনিক উপস্থাপনা অসাধারণ। ছবিটিতে হ্যাপি আখন্দ অভিনয়ও করেছেন। ছবির ‘সখি চলো না জলসাঘরে এবার যাই’ এ গানটিও অনবদ্য।
বাণিজ্যিক ছবির মধ্যে আসাদের লিপে ‘প্রথম প্রেম’ ছবির ‘মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে’ অন্যতম কালজয়ী গান। এছাড়া নব্বই দশকে হাসান চৌধুরীর তুমুল জনপ্রিয় গান ‘খুব কাছাকাছি তুমি আমি আছি’ ব্যবহৃত হয়েছে আসাদ অভিনীত ‘বুকের ভিতর আগুন’ ছবিতে। গানে রসায়ন ছিল আসাদ ও ফাল্গুনী হামিদের।
চারবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন; ১৯৯৩ – পদ্মানদীর মাঝি, ১৯৯৫ – অন্যজীবন, ১৯৯৭ – দুখাই ও ২০০১ – লালসালু।
আসাদ সেই শিল্পী যার অভিনয়জীবনে অভিনয়টাই ছিল মূখ্য বিষয়। তাঁর অভিনয় দেখে অভিনয়শিল্পকে শ্রদ্ধা করা যায়।
অভিনেত্রী চিত্রলেখা গুহ একবার গর্ব করে বলেছিলেন-’ঐ বাংলায় বাতি লাগিয়ে খুঁজলেও একজন রাইসুল ইসলাম আসাদ পাওয়া যাবে না।’ কথাটির মধ্যে অনেকের অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে কিন্তু আল্টিমেটলি কথাটা সত্য। আসাদ একজনই।