Select Page

জান্নাত : পাপ ছাড়ে না বাপকেও!

জান্নাত : পাপ ছাড়ে না বাপকেও!

নাম : জান্নাত
ধরণ : সোস্যাল- রোম্যান্টিক- থ্রিলার
পরিচালক : মোস্তাফিজুর রহমান মানিক
কাস্টঃ সাইমন সাদিক (আসলাম/ ইফতেখার), মাহিয়া মাহী (জান্নাত), আলী রাজ (নূর মোহাম্মদ), শিমুল খান, চিকন আলী, মিশা সওদাগর (পীর) প্রমূখ।
প্রযোজনা : এস.এস মাল্টিমিডিয়া
মুক্তি : ২২ আগস্ট, ২০১৮
ভাষা : বাংলা

⚾ নামকরণ : ছবির লিড রোলে থাকা মাহিয়া মাহী’র চরিত্রের নাম অনুসারেই এছবির নামকরণ “জান্নাত” করা হয়েছে। আমার কাছে নামকরণ মোটামুটি যথার্থ এবং সুন্দর লেগেছে।আশাকরি সবাই এই রিভিউটি পড়ার পর এর নামকরণের সার্থকতা হলে গিয়েই খুঁজে নিবেন।

⚾ কা.চি.স (কাহিনী+ চিত্রনাট্য+ সংলাপ) : কোনোরকম স্পয়লার দিতে চাই না, তাই ট্রেইলারে যতটুকু দেখানো হয়েছে সে সম্পর্কেই আলোচনা করি।

জান্নাত, গ্রামে বাস করা এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তার বাবা হলেন ঐ গ্রামের এক বহু পুরোনো মাজারের খাদেম, তিনি তার পূর্বনুসারৗদের সূত্র ধরে এই মাজারের খেদমত করে আসছেন। একদিন সেই মাজারে এক কঠিন আল্লাহভক্ত ছেলেকে দেখে তার অনেক বেশি পছন্দ হয় এবং তিনি সেই অনাথ ছেলেকে তার ঘরেই আশ্রয় দেন। দিনের পর দিন তিনি সেই ছেলের আচার, আচরণ, আল্লাহভক্তি, শ্রদ্ধায়, ভদ্রতায় এতোটাই বেশি সন্তুষ্ট হোন যে, তিনি একসময় ঠিক করে ফেলেন তার মেয়ে জান্নাতের জন্য এই ছেলেই উপযুক্ত। কিন্তু এর পরেই, বেশকিছু ঘটনার মাধ্যমে পিতা নূর মোহাম্মদ এবং জান্নাতসহ পুরো গ্রামবাসী জেনে যায় সেই ছেলে এক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য।

এখন… সমস্ত গ্রামবাসীর কানে খবরটি কীভাবে ছড়ায়, ছেলেটি যদি জঙ্গিই হয় তাহলে কেনই বা সে-ই মাজারেই আসলো, কীভাবে সে জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়, তাদের কর্মকান্ড কী কী ছিল এবং এরপর তার ও পিতা-মেয়ের কী পরিনতি হয়…. এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে যদি ছবিটি দেখেন।

অভারঅল আমার কাছে কনসেপ্টটা অনেক ভালো লেগেছে। একদমই সময়উপযোগী এবং মৌলিক গল্প। স্ক্রিনপ্লেও মোটামুটি গোছানোই ছিল। ছোটখাটো কিছু ভুল ছাড়া তেমন অভিযোগ করার মতো কিছু পাইনি।

তবে এ ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এর ডায়ালগ। যিনি সংলাপ লিখেছেন তার মেধার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। রোম্যান্টিক মুভির সংলাপ যদি শক্ত না হয়, কানে যদি না লাগে, তাহলে সে গল্পই একদম পানসে হয়ে যায়। এ ছবিতে তেমনটা হয়নি।

এ অংশ কে দিচ্ছি ১০০ তে ৮০।

⚾ টিমওয়ার্ক : কয়েকটি চরিত্র বাদ দিলে এছবিতে প্রায় সবার চরিত্রই গতানুগতিকের বাইরে ছিল। আল্লাহর একজন অন্ধ ভক্ত আসলাম, একজন সাধারণ ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র ইফতেখার, মাজারের খাদেম নূর মোহাম্মদ, তার মেয়ে জান্নাত, কিংবা একজন পীর যিনি সাধারণ মানুষদের মহান আল্লাহ’র কালামের ভুল মাস’আলা দিয়ে বিপথে নেয়… প্রতিটি চরিত্রই এদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত ছিল।

মাহিয়া মাহী এবং সাইমন সাদিক, দুজনই আমার দেখা তাদের সেরা পার্ফর্মেন্স দিয়েছে এছবিতে। মাহির সাবলীল অভিনয়, এক্সপ্রেশন, ডাবিং সবকিছু একদম পার্ফেক্ট ছিল! তার এ্যকটিং এ ন্যাকামি কম ছিল। কিছু সিনে অতিরিক্ত মেকআপ নেওয়া হয়েছে, তবে কমার্শিয়াল মুভির কথা চিন্তা করে নেগেটিভ হিসেবে নিচ্ছি না।

সাইমন সাদিকের প্লে করা দুটি চরিত্রের মধ্যে আসলাম চরিত্রটি আমার বেশ ভালো লেগেছে। তার অভিনয়ে একটু দূর্বলতা ছিল, কিন্তু তিনি তার চরিত্রের প্রতি ডেডিকেশন, ইনোসেন্ট লুক, কান্নার এক্সপ্রেশন দিয়ে সেটা পুষিয়ে দিয়েছেন।
আলী রাজের কাছ থেকে সিনিয়র অভিনেতা হিসেবে যতটুকু আশা করেছি ঠিক তেমনটাই পেয়েছি। তার চরিত্রে ব্যবহার করা অনেক গুলি স্ট্রং ডায়ালগ রয়েছে যা আপনাকে ইসলাম সম্পর্কে ভাবাবে। মিশা সওদাগরকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে পেয়েছি এছবিতে। তাকে বলতে গেলে একদম কালে ভদ্রেই এমন ভিন্নরূপে পাওয়া যায়। চরিত্রের ব্যপ্তি কম হলেও গল্পে তার সেই চরিত্রের গুরুত্ব ছিল। কোনো উচ্চকিত ডায়ালগ ছিল না, স্বাভাবিকভাবেই ডাবিং করা হয়েছে।

শিমুল খানের চরিত্রের ব্যপ্তি খুবই কম ছিল। চরিত্রটি ভালো মতো লেখা হয়নি, নাহলে আরো মজার কিছু দেখানো যেতো। চিকন আলী বরাবরের মতোই গতানুগতিক ছিলেন। কমেডির সম্পূর্ণ গুরুদায়িত্ব তার ওপরই ছিল। পুলিশের এস.আই নাহিদ চরিত্রটি যে করেছেন (নাম মনে পড়ছে না) তার অভিনয় ভালো লাগেনি। কিছু কিছু জায়গায় ভুল শব্দ উচ্চারণ করেছেন। যেমন; পুলিশের এক কর্মকর্তার সাথে কথা বলার সময় তিনি বললেন, “I am right?” যিনি grammar জানেন তিনি সহজেই বুঝতে পারবেন ভুলটা কোথায়। এমন আরো কিছু ভুল রয়েছে তার উচ্চারণ এবং অভিনয়ে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭০।

⚾ কারিগরি : সিনেমাটোগ্রাফি খুব একটা আহামরি কিছু হয়নি। নরমাল লেগেছে। আক্ষেপ হয়েছে ছবিটি ওয়াইড স্ক্রিনে শ্যুট হলে দেখে আরেকটু ভালো লাগতো। তবে ড্রোন শট গুলি ভালো ছিলো।

মানিকগঞ্জের সৌন্দর্য্য দেখাতে ডিরেক্টর মোস্তাফিজুর রহমান মানিক কোনোরকম কার্পণ্য করেননি। প্রায় সম্পূর্ণ ছবিটি সেখানেই শ্যুট করা হয়েছে। ছবিতে একটা চেজিং সিন রয়েছে, সেখানে ক্যামেরার কাজ বেশ ভালো হয়েছে। কালার গ্রেডিং ভালো হলেও ওভারঅল এডিটিং ঠিকঠাক ছিল না। একটা সিনে দেখানো হয়েছে মাহি বাগানে প্রজাপতি নিয়ে আমোদ করছেন, এই সিনটার এডিটিং হয়েছে বিয়েবাড়ির এডিটিং এর মতো (!) রিয়েল লোকেশন ব্যবহার করা উচিত ছিল এখানে।

ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ মোটামুটি ছিল, এখানেও আরেকটু ভালো করার সুযোগ ছিল, কেমন যেন একটা খামতি রয়ে গেছে এখানে। তবে সবার কস্টিউম সিলেকশন একদম পার্ফেক্ট ছিল। ধর্মীয় সাজপোশাক থাকলেও বেশ কালারফুল ছিল।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৪৫।

⚾ বিনোদন : সাইমন-মাহীর রোম্যান্স এছবির বিনোদনের মূল উপকরণ। রোম্যান্স বলতে এখানে কোনো কিছুই অতিরিক্ত কিংবা অন্তরঙ্গ দেখানো হয়নি, দেখানো সম্ভবও না। যাই ছিল তা পরিমিত পর্যায়ে ছিল, দেখতে ভালো লেগেছে। ছবিতে কমেডি যা ছিল তা তেমন উপভোগ্য হয়নি। ফাইট সিনের কোরিওগ্রাফি মোটামুটি হয়েছে। ছবির প্রথমার্ধে ছিল রোম্যান্স, আর দ্বিতীয়ার্ধ ভরা thrill এ।

ডায়লগের পর এ ছবির দ্বিতীয় প্লাস পয়েন্ট হলো এর গান। ছবিতে মোট ৫ টি গান রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে একটি গজল এবং একটি কাওয়ালী। আরফিন রুমির অসাধারণ গলায় দুইটি গানই খুবই ভালো লেগেছে। এটা বলাই যায়, পরিচালক আরফিন রুমির এমন God gifted voice এর একদম সদ্ব্যবহার করেছেন। ৫ টি গানের ৪ টিই তিনি গেয়েছেন। একটি গেয়েছেন বাপ্পা মজুমদার, তবে তার গাওয়া “খুব বলতে ইচ্ছে হয়” এর প্রথম দুই লাইনের সুরের সাথে ভারতের সনু নিগাম এবং শ্রেয়া ঘোশালের গাওয়া “তেরে বিন” গানটির মেইন পোর্শনের সুরে অনেক মিল (!) তবে পুরো গানটি নয়, “খুব বলতে ইচ্ছে হয়, আদরে গলতে ইচ্ছে হয়” এই দুই লাইনে ব্যবহার করা সুর একরকম লাগলো। বাকি একটি রোমান্টিক সং এবং একটি স্যাড সং ভালো লেগেছে।

যদি আপনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করেন, মিউজিক অংশে যদি আপনি সুদীপ কুমার দীপ ইমন সাহা, বাপ্পা মজুমদার, আরফিন রুমি, পড়শী, কোনালদের মতো গুণী এবং জনপ্রিয় শিল্পীদের একসাথে পান, ধরে নিতেই হবে সেই কাজটি অন্য যেকোনো অংশ থেকে বেটার হবে। এখানেও তাই হয়েছে।

এ অংশ কে দিচ্ছি ১০০ তে ৫০।

⚾ ব্যক্তিগত : ছবিটি প্রথমেই আমার নজরে পড়ে এর চোখধাঁধানো পোস্টার দিয়ে। আমি মনে করি, এই কাজ দিয়ে তারা অন্যান্য পোস্টার এডিটরদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, হল পোস্টার কীভাবে বানাতে হয়!

ছবিতে কিছু জিনিস চাইলে আরেকটু বিস্তারিত দেখানো যেতো। যেমন; আতংকিত সিরিজ বোমা হামলার পরিকল্পনা কীভাবে করা হচ্ছে, কোনো নাস্তিক লেখক, ব্লগারকে হত্যা করবার পূর্বে তাকে ট্র্যাপে ফেলার প্ল্যান কীভাবে করা হয়। এগুলো দেখানোর জন্য কোনো বাজেটের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন আইডিয়ার!

ওভারঅল আমার কাছে “জান্নাত” মোটামুটি সন্তোষজনক ছিল। ছবির প্রথমার্ধ অনেক বেশি দীর্ঘ লেগেছে। সে তুলনায় দ্বিতৗয়ার্ধে নতুনত্ব ছিল এবং জমজমাট ছিল। আফটারঅল, প্রায় ৪ মিনিটের ট্রেইলার দিয়ে তারা প্রায় ছবির অর্ধেক দেখিয়ে ফেলেছে। তবে এমন ভিন্নধর্মী কন্সেপ্টে ছবি তৈরির জন্য “জান্নাত” টিমের কিছুটা সাধুবাদ প্রাপ্য।

রেটিং:- ৭/১০

⚾ ছবিটি কেন দেখবেন : এটি একদম ফ্যামিলি নিয়ে দেখার মতো ছবি। বেশকিছু সোস্যাল ম্যাসেজ রয়েছে ছবিতে। “পোড়ামন” জুটির পরিণত রসায়ন উপভোগ করতে পারবেন। ইসলাম সম্পর্কে বেশ কিছু জানা-অজানা তথ্য জানতে পারবেন। পাশাপাশি রোম্যান্টিক-থ্রিলার যারা পছন্দ করেন তাদের জন্য এছবি।


মন্তব্য করুন