![অনুদান পাওয়ার সাত বছর পর মুক্তি পাচ্ছে ‘আজব কারখানা’](https://i0.wp.com/bmdb.co/wp-content/uploads/2024/06/ajob_karkhana1_bmdb_image.jpg?resize=150%2C150&ssl=1)
সালতামামি ১৯৯৮: এ জে মিন্টু, শিবলী সাদিকদের পিছু হটার বছর
ঢাকাই চলচ্চিত্রের ১৯৯৮ সালের এই সালতামামি প্রথম আলোর করা। যার শিরোনাম ‘লগ্নি ৭৫ কোটি টাকার ফেরত ৩০ কোটি’। সেখানে বলা হয় মেগাহিট ২০টি ছবি নেই এ বছর। হাতেগোনা কয়েকটি ছবি খুবই ভালো ব্যবসা করলেও প্রায় ৪৫ কোটি টাকা পানিতে গেছে। ৭৫ কোটি টাকার নির্মাণ বায়ে প্রযোজকরা পেয়েছেন মাত্র ৩০ কোটি টাকা।
![](https://i0.wp.com/bmdb.co/wp-content/uploads/2023/06/year_1998_bangla_movie_bmdb_image.jpg?resize=862%2C482&ssl=1)
এ জে মিন্টু, শিবলী সাদিক ও মতিন রহমান- আলোচিত তিন নির্মাতার ছবি এ বছর ব্যর্থ হয়
এই বছর ৭৩টি ছবি মুক্তি পায়, ব্যয় ছিল প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। সারা বছরের হিসাবে ৭৫ কোটি টাকা থেকে পুঁজি ফেরত এসেছে ৩০ কোটি টাকার মতো। বাকি ৪৫ কোটি টাকা হাওয়া। ফলে এ বছর সিনেমা শিল্প ব্যবসায় মারাত্মক ধস নামে। ১৯৯৭ সালে ৯০টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। টাকা লগ্নি হয়েছিল ৯২ কোটি। প্রযোজকরা ঘরে পুঁজি তুলেছিলেন ৭০ কোটি টাকার ওপর।
১৯৯৭ সালে সারা দেশে সিনেমা হল চালু ছিল ১২০০ এর মতো। কিন্তু এ বছর চালু ছিল ১০০০। ডিসেম্বরেই ঢাকা শহরে বন্ধ হয়ে গেছে চারটি সিনেমা হল। পাশাপাশি দেশের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের পাঁচটি সিনেমা হলও। এছাড়া সর্বশেষ হিসাব মতে দেখা গেছে, সার দেশের প্রায় ৫০টির মতো হলঘর বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রথম আলো ওই সালতামামিতে কয়েকটি মন্তব্য যোগ করে। প্রযোজক, পরিবেশক ও পরিচালক আলমগীর কুমকুম বলেন, শ্রীপুরের একটি হলের মালিক আমি। বছরের শুরু থেকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য একটি হলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন ছবি রিলিজ করেছি সবসময়। ১ লাখ টাকা দিয়ে ছবি নিয়েছি, কিন্তু প্রায় সব ছবিতেই মার খেয়েছি। কেননা ফিক্সড টাকায় ছবি নিতাম। টাকা না উঠে আসলেও ছবি ফেরত দিতে হয়েছে। এভাবে মার খেতে খেতে শেষটায় এমন এক অবস্থা হয়েছে যে হলের ম্যানেজার শেষ পর্যন্ত আমাকে বললো ১০ হাজার টাকায় ছবি নিতে।
সাঈদ নামের একজন হল বুকিং এজেন্ট জানান, আমি প্রতিসপ্তাহে দুটি নতুন ছবি এবং ৪/৫টি পুরাতন ছবি ঢাকার বাইরের হলগুলোর জন্য বুকিং দেই। কিন্তু এখন এই ব্যবসা থেকে মান উঠে যাচ্ছে। বিশেষ করে এ বছরে অধিকাংশ ছবিতেই আমরা মার খেয়েছি। দুতিনটি বড়জোর পাঁচটি ছবিতে লাভের মুখ দেখেছি। পুরো বছরটাই ছিল আমাদের জন্য মন্দা বছর। আগে যেখানে নতুন ছবি নেয়ার আগে ছবি মালিকদের অনায়াসে ১ লাখ টাকা দিতে পারতাম, সেখানে এবারে ৫০ হাজার টাকা দেয়াটাও ছিল বড় কষ্টের। তারপরেও চেষ্টা করেছি বড় অংকের টাকা দিয়ে ছবি নিতে। … এক একটা ছবিতে আমি এবং আমার হল মালিক মার খেয়েছি আর পরের ছবি নিয়ে বুকে আশার আলো সঞ্চয় করেছি। কিন্তু এভাবে এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম যে সবমিলিয়ে এ বছরে আমাদের পিঠ দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। তারপরেও আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে আবার নতুন করে আশার আলো সঞ্চয় করছি। যদি আবার লাভের মুখ দেখি।
পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, ব্যবসা সফলতার কথা বললে আমি বলবো ৭৩টি ছবির মধ্যে এমন ১০টি ছবিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে ১০টি ছবি সুপার ডুপার হিট হয়েছে। এতেই বোঝা যায় যে, কেমন মন্দার বছর ছিল ১৯৯৮।
প্রথম প্রথম অনেকের ধারণা হতো ভালো ছবি নির্মাণ হয় না বলেই প্রযোজকরা ব্যবসায়িকভাবে মার খাচ্ছে। কিন্তু তা ঠিক নয়। এ বছর বেশ কিছু ভালো ছবি নির্মাণ হয়েছে। যে ছবিগুলোর প্রতিটির নির্মাণ বায় ছিল ১ কোটি টাকার উপরে। ছবিগুলো হচ্ছে এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘বাপের টাকা’, মোতালেব হোসেন পরিচালিত ‘ভালোবাসার ঘর’, সৈয়দ হারুন পরিচালিত ‘অচল পয়সা, ওয়াকিল আহমেদ পরিচালিত ‘অধিকার চাই’, সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘আমার দেশ আমার প্রেম’, ‘অগ্নিসাক্ষী’, নাসিরউদ্দিন দিলু ও রুহুল আমিন বাবুলের আমি সেই মেয়ে’, জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘এ জীবন তোমার আমার’, মুখলেসুর রহমান গোলাপ পরিচালিত ‘শেষ প্রতীক্ষা’, মতিন রহমান পরিচালিত ‘রঙ্গীন নয়নমনি’ এবং শিবলি সাদিক নির্দেশিত সেলিম আজম পরিচালিত ‘অনেক দিনের আশা’।
অধিকাংশ প্রযোজক, পরিচালক এবং শিল্পীর মতে এই ১১টি ছবির মধ্যে মোতালেব হোসেনের ভালোবাসার ঘর’, নাসিরউদ্দীন দিলু ও রুহুল আমিন বাবুলের ‘আমি সেই মেয়ে’ ব্যবসায়িকভাবে একটা পর্যায়ে মূল পুঁজি তুলে আনলেও অন্য ছবিগুলো পুঁজি ঘরে তুলতে পারেনি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা দুই পরিচালক, প্রযোজক। এ জে মিন্টু এবং শিবলি সাদিক। এ জে মিন্টুর ‘বাপের টাকা’র নির্মাণ এবং অন্যান্য ব্যয় ছিল দেড় কোটি টাকা। ছবিটি যে একবার দেখেছে সে আর একবার দেখতে চেয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকেই এই দেখার দর্শক ছিল অতি নগণ্য। ফলে প্রথম শ্রেণীর একজন খ্যাতিমান পরিচালক এ জে মিন্টুর এই অসাধারণ ভালো ছবিটি একেবারেই মুখথুবড়ে পড়ে। পরবর্তীকালে এ জে মিন্টু নতুন করে আর কোনো ছবি নির্মাণে হাত দেননি। পাশাপাশি শিবলি সাদিক প্রযোজিত, সেলিম আজম পরিচালিত ‘অনেক দিনের আশা’ ছবিটিও ভালো গল্পের ভালো ছবি হওয়া সত্ত্বেও এ ছবিটিও ব্যবসায়িকভাবে মার খেয়েছে। অনেকেরই মতে ‘অনেক দিনের আশা’ ছবিটি এমনই একটি ছবি, দর্শক চোখের পানি ঝরিয়ে হল থেকে বের হয়েছে। কিন্তু ছবিটি তারপরেও ফ্লপ। কারণ সব শ্রেণীর দর্শক এ ছবি দেখতে হলে আসেনি। বিশেষ করে হলে আশানুরূপ মহিলা দর্শক পাওয়া যায়নি। এই ছবি দুটির পাশাপাশি আরো একটি বিগ বাজেটের ভালো ছবি সুপার ফ্লপ হয়েছে। মতিন রহমান পরিচালিত রিমেক ছবি ‘নয়নমনি’। ৭০ দশকের পর ‘রঙ্গীন নয়নমনি’ ছিল এ দেশের প্রথম মেগাহিট ছবি। এই ছবির এবারে নির্মাণ ব্যয় ছিল ১ কোটি টাকার উপরে।
সিনেমা ব্যবসার এই চরম ক্ষতির জন্য অনেক প্রযোজককেই এবারে বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। ‘অনেক দিনের আশা’র প্রযোজক অজিত নন্দী ও শিবলি সাদিক সিনেমা ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। ‘নয়নমনি’র প্রযোজক জাহাঙ্গীর খান বলেই দিয়েছেন, আর নয়। এ জে মিন্টুর মতো নির্মাতা ছবি নির্মাণ করছেন না। এ রকম বেশ কয়েকজন প্রযোজক ইতিমধ্যে সিনেমা লাইন ছেড়ে অন্য ব্যবসায় নেমেছেন। এ বছরের মন্দা জোয়ারের কারণে আগামী বছর ৫০টি ছবিও মুক্তি পাবে না বলে অনেকে আশংকা প্রকাশ করেছেন। কেননা প্রয়োজকরা বাজার চাঙ্গা না হওয়া পর্যন্ত মাঠে নামছেন না।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, ছবির বাজারে এতোটা ধস নামলো কেন? এ নিয়েই এখন প্রয়োজক অফিসগুলোতে হিসাব-নিকাশ চলছে। কয়েকজন প্রযোজক বলেন, এ বছরে ছবির বাজার খারাপ যাওয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, বছরের শুরুতে ছবির বাজার চাঙ্গা হলেও বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় হলগুলো ফাঁকা গেছে। দর্শক একেবারেই আসেনি। এরপর হঠাৎ করেই দেশে এলো ভয়াবহ বন্যা। বন্যার সময় এবং বন্যার পর গ্রামেগঞ্জে জেলা সদরে সাধারণ মানুষের দরিদ্রতা এতোই বেড়েছে যে সিনেমা হলে টিকিট কেটে ছবি দেখার মতো টাকা-পয়সা তাদের কাছে ছিল না। এর পরপর আবার শুরু হলো উইলস ক্রিকেট কাপ। এ সময় তো ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলা সদরের হলগুলো একেবারেই ফাঁকা গেছে। তার ওপর এই খেলা রেডিও, টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। ফলে সারা দেশের মানুষ টিভি আর রেডিওর সামনেই ঝুঁকে ছিল।
অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এবারে যে ছবিটি হঠাৎ করে ব্যবসা সফল হয়েছে, হল মালিকরা ঐ একটি ছবিই একমাস ধরে চালিয়েছে। দর্শকও হুজুগে মাতাল হয়ে দেখেছে। ফলে ঐ একটি ছবির ধাক্কায় পুরো মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত অন্য সাতটি ছবি সুপার ফ্লপ হয়েছে।
আর এ বছরে অনেক পরিচালক ছবির পুঁজি ফেরত আনার জন্য অতি মাত্রায় কাটপিসের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। ঢাকার বাইরে এক্সট্রা মেয়েদের নগ্ন ছবি দেখানোর খবর পাওয়া গেছে। ফলে ঐ একটি ছবি দেখার জন্য একশ্রেণীর দর্শক ভালো ছবি দেখা বাদ দিয়ে নগ্ন দৃশ্যের সেই ছবিটি দেখার জন্য হলঘরে ভিড় করেছে। ফলে ঐ মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত অন্য ছবিগুলো ব্যবসায়িকভাবে মার খেয়েছে। কাটপিসের সংযোজন করার ফলে হঠাৎ করে ঢাকাসহ সারা দেশের হলগুলোতে মহিলাদের উপস্থিতি কমে যায়।
এই কারণে সামাজিক বিনোদনমূলক সুস্থ ছবিগুলো ফ্লপ হয়েছে। তারপরেও সবচেয়ে বড় কথা সিনেমা শিল্পের প্রাণ হচ্ছে এ দেশের মধ্যবিত্ত দর্শক। সেই মধ্যবিত্ত দর্শক আমরা হারিয়ে ফেলছি ক্রমশ। তার ওপর এখন হলের পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ। মা-বাবা-ভাইবোন নিয়ে একত্রে ছবি দেখার মতো হাতেগোনা ১০টা হলঘর নেই এ দেশে। অন্যদিকে গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে আকাশ সংস্কৃতি। বম্বের হিন্দি ছবি দেখে দেখে অনেক দর্শক বাংলা ছবির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এ জন্য আকাশ সংস্কৃতিকে শাসন না করতে পারলে আগামীতে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে আমাদেরকে। ডিশ লাইনের মাধ্যমে চোরাই বাংলা ছবির ভিডিও ব্যবসা চালিয়ে এখন আবার আমাদের বারোটা বাজাচ্ছে একশ্রেণীর লোক। এসব বন্ধ করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ট্যাক্স কমিয়ে হলের পরিবেশ সুন্দর ও নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। কাটপিস বন্ধ করে সুস্থ ছবি বানাবার গ্যারান্টি দিতে হবে। চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হবে। দর্শককে বাংলা ছবি দেখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। তবেই আগামী বছর এ বছরের লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে অধিকাংশ নির্মাতা, প্রযোজকের বিশ্বাস।
১৯৯৮ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ৭৩টি সিনেমার মধ্যে ব্যবসাসফল ১০টি— শান্ত কেন মাস্তান (মান্না, শাহনাজ, রাজ্জাক, হুমায়ূন ফরীদি, নাসরিন); ভন্ড (রুবেল, তামান্না, রাজীব, হুমায়ূন ফরীদি, এটিএম শামসুজ্জামান); তেজী (মান্না, একা, শাহিন, ডিপজল, কাবিলা, সাদেক বাচ্চু); মৃত্যুর মুখে (ইলিয়াস কাঞ্চন, মুনমুন, আমিন, ময়ূরী); কালো চশমা (রুবেল, একা, মেহেদী, মৌ, হুমায়ূন ফরিদী); পৃথিবী তোমার আমার (শাবনূর, রিয়াজ, রাজ্জাক, ফারুক); এই মন তোমাকে দিলাম (শাকিল, পপি, ববিতা); রাঙা বউ (আমিন, ঋতুপর্ণা, হুমায়ূন ফরীদি); মা যখন বিচারক (শাকিল, পপি, বাপ্পারাজ, নিশি, শাবানা, আলমগীর); সাগরিকা (হেলাল, ঋতুপর্ণা, আমিন)।
মোটামুটি ব্যবসাসফল/হিট ছবি— ভালোবাসার ঘর, আমি সেই মেয়ে ইত্যাদি।
ভালো কিন্তু ফ্লপ হয়েছিল এমন নয়টি ছবি— বাপের টাকা, অচল পয়সা, অধিকার চাই, আমার দেশ আমার প্রেম, অগ্নিসাক্ষী, এ জীবন তোমার আমার, শেষ প্রতীক্ষা, রঙ্গীন নয়নমনি, অনেক দিনের আশা।
শীর্ষ ৫ নায়ক— মান্না, ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল, শাকিল খান ও আমিন খান; শীর্ষ ৫ নায়িকা— পপি, শাবনূর, মৌসুমী, তামান্না ও একা। সর্বাধিক ছবির নায়ক/নায়িকা— মান্না (১৪টি) ও শাহনাজ (৮টি)।
পত্রিকা সংগ্রহে: ফয়সাল বারী