প্রেম ও বাস্তবতার রূঢ় বয়ান ‘হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা’
মানুষের সবচেয়ে অদ্ভুত আবেগের নাম যদি হয় প্রেম, তবে তারচেয়ে বড় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কঠোর কঠিন বাস্তবতা। যুগে যুগে এই দুইয়ের গোলকধাঁধায় বহু দৃঢ়চিত্তের মানুষও কখনো কখনো পা বাড়িয়েছে ভুল পথে। আবার সময় এবং স্বীকৃতির প্রয়োজনে কেউ দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিয়েছে বাস্তবতা। তবে প্রেম এবং বাস্তবতার মধ্যে যদি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্র কিংবা স্বাধীনতা, তবে মুগ্ধতার বিষ কিংবা বিবেক-বোধ নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিতে হয় হাসিমুখে। তখন শাসকদের জন্য প্রতিটি ঘটনায় একটি মাত্র পথ খোলা থাকে, তা হলো কৌশলী হওয়া।
প্রাচীন মিশরের প্রেক্ষাপটে প্রেম ও বাস্তবতার মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার রূঢ় বয়ান ‘হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা’।ইতিহাস পুরান আশ্রিত নাটকের প্রতি আমার একটা আলাদা দুর্বলতা আছে,তাই যখন শুনলাম শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা’ তখনই অফিস শেষ করেই ছুট লাগালাম সেগুনবাগিচার দিকে।
প্রাচীন মিশরীয় রানী ক্লিওপেট্রার সাথে সম্পর্কিত জুলিয়াস সিজার,এন্টোনি, ব্রুটাস নামগুলো যতটা পরিচিত হার্মাসিস ততোটা পরিচিত নন। কিন্তু অনুস্বরের ‘হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা’ নাটকের মধ্য দিয়ে আমরা হার্মাসিস চরিত্রটিকে গুরুত্বের সাথে দেখি। এই নাটকের নির্দেশক মোহাম্মদ বারীর বয়ানে আমরা দেখি যে ইংরেজ ঔপন্যাসিক স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের ক্লিওপেট্রা উপন্যাসে পেয়ে যাই হার্মাসিসকে,যেখানে মিশরীয় সভাসদদের গোপন সভায় হার্মাসিসকে মিশরের সম্রাট নির্বাচিত করা হয়। দেবতাদের আদেশে হার্মাসিস হচ্ছে সেই ব্যাক্তি যে রানী ক্লিওপেট্রাকে হত্যা করে মিশরীয়দের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। হার্মাসিসের শিক্ষক পর্যন্ত তার শেখানো শিক্ষা ভুলে গিয়ে নিরস্ত্র নারীকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করতে বলেন এবং এ কাজে সাহায্য করবে চারমিয়ন ও সেনাধ্যক্ষ পলাস।
ভবিষ্যৎবক্তা হিসেবে এন্টনির কাছে ক্যাসিয়াসের পরাজয় হবে বলে ভবিষ্যৎবানী করে হার্মাসিস সহজে ক্লিওপেট্রার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেনএবং ক্লিওপেট্রার রুপে গুনে বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যান। এতে হার্মাসিসের প্রতি চারমিয়ন চরম ক্ষুদ্ধ হন। চারমিয়ন স্বপ্ন দেখছিলেন ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর তিনি হবেন মিশরের সম্রাজ্ঞী, কিন্তু ক্লিওপেট্রা-হার্মাসিসের প্রণয় সহ্য করতে না পেরে চারমিয়নই প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর ফলশ্রুতিতে সেনাধ্যক্ষ পলাস বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড পায়। কিন্তু হার্মাসিসের প্রতি অনুরাগের বশবর্তী হয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখে ক্লিওপেট্রা। রোমের সম্রাট মার্ক এন্টনির বিরুদ্ধে মিশরকে বাঁচানোর প্রতিরোধস্বরূপ গোপন সম্পদ কুক্ষিগত করে হার্মাসিসের সহযোগিতায় এবং হার্মাসিসকে বিয়ে করবে বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু যখন মার্ক এন্টনি দূত পাঠিয়ে কড়া বার্তা দেয় তখনই হার্মাসিসকে প্রত্যাখ্যান করে এন্টনির সাথে সমঝোতা করতে ক্লিওপেট্রা এগিয়ে যান।
এভাবেই নাটকটি শেষ হয়। এই নাটকের কিছু উল্লেখযোগ্য সংলাপ ‘পৃথিবীর প্রতিটি প্রাপ্যই শর্ত সাপেক্ষ’, ‘যুদ্ধের মাঠে যারা বিজয়ী পক্ষ মহানুভব দেবতারা শুধু তাদের পাশেই দাঁড়ান’, ‘কোন হত্যাই একজন সুস্থ মানুষকে আনন্দ দিতে পারে না’, ‘প্রত্যেকটি পরাজয় একটি নতুন জয়ের দ্বার উম্মোচন করে’, ‘ক্রোধ হচ্ছে অক্ষমের আস্ফালন, তবুও মানুষের মধ্যে ক্রোধ থাকা ভালো’, ‘মানুষের চরিত্রের চূড়ান্ত ও দূর্বলতম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে প্রেম’, ‘রাজনীতিতে আবেগের কোনো স্থান নেই, রাষ্ট্র পরিচালনায় শাসকদের জন্যে প্রতিটি ঘটনায় একটি মাত্র পথ খোলা থাকে তা হচ্ছে কৌশলী হওয়া, চাল ভুল করলে পতন অনিবার্য’।
অসংখ্য ধন্যবাদ অনুস্বর নাটকের দল, এই নাটকের রচয়িতা রাহমান চৌধুরী, নির্দেশক মোহাম্মদ বারীসহ সকল কলাকুশলীদের। চমৎকার সেট, কোরিওগ্রাফি, চমৎকার অভিনয় এই নাটকটিকে বহুগুণ সমৃদ্ধ করেছে।