Select Page

ভালগার হইতে না পারার ব্যর্থতা সমেত ‘সিনপাট’

ভালগার হইতে না পারার ব্যর্থতা সমেত ‘সিনপাট’

সিনপাট নিয়ে কথা বলতে গেলে ‘শাটিকাপ’ নিয়ে না বলে থাকা আসলে মুশকিল। বাট, আমার মনে হইছে, এ তুলনা বাদ দিয়ে বলাবলির মাঝে ‘সিনপাট’রে আলাদা করে বোঝা যাবে। আলাদা মানে ‘সিনপাট’ আসলে কী সেটা। আলাদা করার জোরাজুরির মাঝে মনে হইছে, ঘটনা এটা না যে দুইটারে তুলনা করতে হবে বা কোনটা বেশি ভালো বা অন্য কিছু হইছে তা বলতে হবে। বরং, ঘটনাটা এমনও হতে পারে- এই যে ওটিটির জগত তারে বাংলাদেশের তরফে আসলে কী দেয়ার আছে, সেটা লেটেস্ট উদাহরণ হইলো ‘সিনপাট’। আর ‘শাটিকাপ’ ও ‘সিনপাট’-এর মাঝে ঢাকার ওটিটিতে এমন কিছু আসে না, যারে নিয়ে গভীরতর ভাবা যায়। সেটা মানুষের অস্তিত্ব ও নাজুকতা নিয়ে খোলামেলা ও অন্তরঙ্গ কিছু বলবে। হ্যাঁ, এরকম প্রতিশ্রুতি আমরা আগেও পাইছি, বাট সেগুলোতে অনেক ফাঁপা ব্যাপার আছে। মধ্যবিত্তীয় রীতিজনিত এবং সেই রীতি ভাঙাজনিত।  

আরো পড়ুন: মাথা নাড়িয়ে দেওয়া ‘সিনপাট’

এটা না যে, আমি গোছায়া কিছু বলব। কিন্তু একটা ব্যর্থতার কথা তো বলি! ‘সিনপাট’-এর ব্যর্থতা। যা হইলো, এটা ভালগার হইতে না পারার ব্যর্থতা। নরমালি আমরা যে মিঠা মিঠা নাটক বা ওয়েব কনটেন্ট দেখি, সেগুলো ভালগার এই অর্থে যে দুনিয়ায় মধ্যে আমরা আছি, তাকে মিঠা করে দেখানোর ভান করে। অন্যদিকে এ ব্যর্থতা হুদায় এমন একটা জায়গায় গিয়া দাঁড়ায় যে, আমাদের মনে হইতে পারে, গ্রাম-মফস্বল নির্মাণের ধারা আমাদের দেখায়া আসছিল কাতুকুতু দিয়া, ‘সিনপাট’ও সেটা না হইতে পারার ব্যর্থতা। এর পরে যেমন দেখেন, মারজুক রাসেল রে স্ক্রিনে দেখলেই মনে হয়, অশ্লীল কিছু একটা হতে যাচ্ছে। উদাহরণ দিলাম মাত্র। কোনো একটা ইউটিউব সিরিজে উনি ও কচি খন্দকার মেবি কলেজ শিক্ষকের চরিত্র করছিলেন। তো, সেখানে ওই রকম কিছু একটা মনে হইছিল। মানে তাদের এমন রোলগুলা প্লে করতে হয়। তারা যাই করেন অশ্লীল মনে হয়। কিন্তু ওই সব ঘটনা সতত রিয়্যালিটিতে যখন ঘটে তখন কতটা অশ্লীল থাকে। এখন যদি মারজুকের ডায়ালগ হয়, ‘পতিতার ছেলে’ … বিষয়টা কই দাঁড়ালো। যারা দৃশ্যটা দেখছেন তারা বুঝবেন। এটা শুধু সমাজে এ ধরনের ডায়ালগ থাকার বিষয় না (যারা এ যুক্তি দেন আরকি)। বাট, ‘সিনপাট’ নিয়ে ভাবতে গিয়া যখন মনে আসলো, যারা দেখছেন, তারা ভাবার চেষ্টা করেন তো এ সিরিজে কয়বার ‘বেশ্যার বেটা’ শব্দটা আছে। সেখানে শ্লীল-অশ্লীলের তর্ক হবে না। অথবা ‘অ্যালান স্বপন’ নামের সুনির্মিত তৃতীয় শ্রেণীর সিরিজে চট্টগ্রামের গালিগুলা শুনেন… এগুলা ভাষার নিজস্ব বুনট, রহস্যময়তা, প্রকাশযোগ্যতারে নষ্ট করে প্রমিতের কাছে হাস্যকর হয়ে উঠতে চায়। যেমন প্রমিত ছাড়া সবই হাস্যকর। এ কারণে ‘অ্যালান স্বপন’ সিরিজে মিথিলার কথা চরিত্রটা কোনো জায়গায় সহানুভূতি নিয়ে হাজির হয় না। উল্টো দিকে ‘সিনপাট’ অবলীলায় ‘বেশ্যার বেটা’দের যেভাবে প্রোর্টে করে, সেখানে এ শব্দগুলোর গুঢ় ইঙ্গিতগুলা আর কৌতুক হয়ে উঠে না। না, এমন না যে খুব একটা নিন্দা করতেছি, কারণ এটা বোধহয় সক্ষমতা ও বোধগম্যতার বিষয়। যেটা সবাই ধরতে পারেন না। তাওকীর ইসলাম যেভাবে পারছেন! আমাদের নাট্য জগতের ব্যর্থতার অংশ হয়ে না উঠার ঘটনায় তিনি সফল হইছেন। ইভেন ভাষার মানটাও বাঁচায়া দিলেন। ফলে, তাওকীর চলনসই হইতে না পারার ব্যর্থতায় ভুগছেন। ভালগার হইতে না পারারও।

আরো পড়ুন: সিনপাট: ‌মোমবাতি-মোমবাতি, শান্তি নাই একরতি!

এই যে সরল আর একটা লিনিয়ার জায়গা থেকে ‘সিনপাট’ আমাদের দেখার মধ্যে হাজির হচ্ছে- মোটামুটি এভাবে একটার পর একটা ঘটনারে দেখি এ দুনিয়ায়। এর মধ্যে টেকনিক দেখানোর কোনো চেষ্টা নাই। বাট, একটা টেকনিক লাগে, নিজের সময় দিন-দুনিয়ারে তুলে ধরার। ছোট ছোট জিনিস। বিয়ার ভিডিওগুলা কেমনে ধারণ হয় বা মানুষ কেমনে বিয়ার আসরে গণ্ডগোলগুলা লাগায়া দেয় বা বিশ্বকাপের উন্মাদনা; এ জিনিসগুলো এত লাইভলি কোথাও দেখছি বলে মনে পড়ে না।

এটা একটা দিক বটে। ‘সিনপাট’র গুরুতর দিক এটাও যে কাদের গল্প বলছে, কীভাবে বলছে। তাওকীর এমন কিছু বিষয় বা শ্রেণী তুলে ধরছে, যেটা এখন পর্যন্ত তিনি ছাড়া কেউ পারেন না। বাংলা সিনামায় কাজী হায়াৎ ও মান্না বোধহয় কিছুটা করছেন। ওইটা তো ভীষণ সিনেমাটিক। সেখানে অনেক কিছু দৃশ্য বা সংলাপ দিয়ে বোঝাইতে হইছে। বাট, ‘সিনপাট’ গভীর কোনো ইশারা না দিয়েই বা বিদ্যমানতারে পাল্টানোর কথা না বলে সরল-সহজ সংলাপের ভেতর যে জীবনকে আমরা ধরতে পারি না, তার খেদ অনেকটাই মিটিয়ে দিছেন। এমন না যে সাদা-কালো-ধূসরের বিভেদ দিয়ে যে জীবন বুঝতে চাই, সেটা আমরা পারি না। বরং জীবনের কোন অংশ কোন পরিস্থিতিতে সাদা, কালো বা ধূসর হয়ে উঠে সেটা স্পষ্ট করেন। সে হিসেবে সোসাইটিতে ভেদ-বিচার বা ভালো-মন্দ আমরা কীভাবে যাচাই করবো, তারে গভীর প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দেয়। এটা স্রেফ ‘আপেক্ষিকতা’র বিষয় নয়। কেন যেন মনে হয় এই যে খারাপ লোকটা, যে খুন করে পালাইয়া যাচ্ছে, সে যেন পালাইতে পারে। কেন এমন হয়! কারণ ভিলেন বা খলনায়কের যে ধারণা নিয়ে আমরা আগাইয়া যাইতে ছিলাম, মাঝে মাঝে তার হিসাব মিলে না। এমন না যে ‘সিনপাট’ এর ফাজু অ্যান্টিহিরো বা ভুল বিচারের শিকার। এবং আমরা যারা দুনিয়ার ভালো চাইতেছি তারা কোথায়! জানি না। কিন্তু এটা বুঝতে পারি যে না দেখার মাঝে গোড়ায় কোনো একটা গলদ আছে। সেটা কী? যেমন দুরু আপারটা আমরা বুঝতে পারি। তেমন গোড়ায় যাইতে বলে হয়তো গল্পটা। যেটা ‘সিনপাট’। ফলে এর সহজ প্রবাহমানতা ও গল্পের পরের অংশে তত থ্রিল না থাকলে আমাদের টানে। কারণ শেষ পর্যন্ত দেখাটা আমারে এমন একটা গলদের কাছে নেবে, সেটা কী আমরা না জানা সত্ত্বেও জানি যে সেটা আছে। এখানে ‘সিনপাট’ আলাদা। এবং খুবই মূল্যবানভাবে আলাদা। যেখানে আপনি যেটা চাইবেন, সেটা কখনো চরিত্রগুলো বলবে না। বরং এ না বলার মধ্য দিয়ে আপনার চাওয়াটারে স্পষ্ট করে তুলবে। যা আমাদের যাবতীয় ব্যর্থতার সঙ্গে ব্যর্থ বিষয়ে কখনো কখনো একমতও হবে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বিএমডিবির সহপ্রতিষ্ঠাতা

মন্তব্য করুন