Select Page

ববিতার দৃষ্টিতে কেমন ছিলেন জসিম

ববিতার দৃষ্টিতে কেমন ছিলেন জসিম

পর্দায় ববিতা জসিমের রসায়ন একটু অন্যরকমই। অবাক করা বিষয় হলো, পরস্পরের বিপরীতে অভিনয়ের আগে ‘সুন্দরী’ সিনেমায় ছিলেন বাবা-মেয়ে। এর আগে অবশ্য ভিলেন চরিত্রে জসিমকে পেয়েছিলেন ববিতা। তারপর নায়ক-নায়িকা চরিত্রে অনেকগুলো সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন।

জসিমের প্রয়াণের পর সাংবাদিক কামরুজ্জামান বাবুর সঙ্গে আলাপচারিতায় সহকর্মী সম্পর্কে কথা বলেছিলেন ববিতা। সম্প্রতি ফেসবুকে সেই পেপার কাটিং পোস্ট করেছেন এমডি রমিজ। আর কিছু তথ্য সংশোধনী হিসেবে উল্লেখ করেছেন বদিরুল ইসলাম। পড়ুন লেখাটি—

বড়ো কষ্ট অনুভব করছি তার মৃত্যুতে। কিইবা আহামরি বয়স ছয়েছিল তাকে? ৫০-এর ঘরে বয়স না পৌঁছাতেই চলে যেতে হলো পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। তরতাজা, হাসিখুশি খোলা মনের মানুষটির মৃত্যু হয়েছে এটা মানতে যতোটা না কষ্ট পাচ্ছি, তারচে’ বেশি কষ্ট হচ্ছে এতো তাড়াতাড়ি একজন প্রিয় মানুষ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে হচ্ছে এটা ভেবেই। আজ আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মরহুম জসিম ভাইকে।

তখন সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজিম ভাই [শেখ লতিফ হবে] পরিচালিত ‘দেবর’ ছবিতে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় জসিম ভাইয়ের সঙ্গে। তখন তিনি ফাইট করান এবং খল চরিত্রে অভিনয় করেন বিভিন্ন ছবিতে। প্রথম পরিচয়ের পর বুঝতে পারলাম জসিম ভাই ভীষণ কাজ পাগল মানুষ।

জসিম ভাই ভীষণ রসিক মানুষ ছিলেন। আড়ালে কোনো কিছু বলতেন না তিনি। যা বলতেন সামনাসামনি বলতেন। ‘রাতের পর দিন’ ছবিতে জসিম ভাই ফাইট ডিরেক্টর ছিলেন। ঐ ছবিতে আমি ছিলাম প্রধান নায়িকা। লাইলী-মজনু, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, নেপালি মেয়ে ইত্যাদি ছবিতে খলনায়ক ছিলেন জসিম ভাই, আর আমি নায়িকা। [নেপালি মেয়ে ছবিতে জসিম ভিলেন নন দ্বিতীয় নায়ক ছিলেন] এর মধ্যে ‘লাইলী-মজনু’ ছবিটা তো ছিলো অসাধারণ। জসিম ভাইয়ের চরিত্রটা এতো সুন্দর হয়েছিলো দর্শক দারুণভাবে উপভোগ করেছিলো।

নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর নওজোয়ান, নবাবজাদি, নিশান ইত্যাদি ছবিতে জসিম ভাইয়ের বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে কাজ করি। [এসব ছবিতে নায়ক নন ভিলেন ছিলেন জসিম]

প্রথম থেকেই জসিম ভাইয়ের মধ্যে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, এই যে তিনি ভিলেন থেকে নায়ক, নায়ক থেকে প্রযোজক হয়েছেন, কিন্তু সবসময় তার মধ্যে ছিল একটা ছেলেমানুষী স্বভাব। হৈ চৈ করে আড্ডা মেরে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। আজ আমি একটা কথা স্পষ্ট করেই বলছি, নায়ক ও নায়িকা হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন এমন অনেকের পেছনেই রয়েছে নামি-দামী প্রযোজক পরিচালকের পৃষ্ঠপোষকতা। কিন্তু জসিম ভাইকে দেখলাম ব্যতিক্রম। তাঁকে কেউ ব্রেক দেয়নি। শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন তিনি। নিজেই নিজেকে গড়েছেন। নিজের যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন কারো সাহায্য ছাড়াও বড়ো হওয়া যায়, প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়।

জসিম ভাইকে প্রথম প্রথম নামি-দামী পরিচালকরা তাদের ছবিতে নেননি। অথচ তিনি তাঁর এই কষ্টের কথা কোনোদিন কাউকে বুঝতে দেননি।

জসিম ভাইয়ের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল। এরপর বেশি টেনশন, বা হৈ-হুল্লোড় করা নিষেধ। অথচ জসিম ভাই চলচ্চিত্রের স্বার্থে একটানা কাজ করে গেছেন। কাজের নেশাটাই বড়ো ছিল এক্ষেত্রে।

একটা ঘটনার কথা বলি, জসিম ভাইয়ের সঙ্গে একবার সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম ‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’ ছবির আউটডোরে। দীর্ঘ এক মাস ছিলাম সেখানে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন মাহমুদ কলি, পরিচালক অশোক ঘোষ এবং আজিজুর রহমান বুলিসহ অনেকেই। সে সময় আমরা সিঙ্গাপুরে একটি বাড়ি ভাড়া করে পরিবারের মতোই ছিলাম। যেহেতু সমস্ত ছবির শুটিং সিঙ্গাপুরে হয়েছিল তাই সবাই খরচ কম করার চেষ্টা করতাম। সকালে রুটি আর রাতে ভাত। সারাদিন না খেয়ে থাকতে হতো। শুটিং শেষে আমরা সবাই মিলে যেতাম সিঙ্গাপুর সুপারমার্কেটে, বাজার সদাই করে সবাই মিলে রান্না করে খেতাম। প্রায়ই খাওয়ার পরে কিছু ভাত থেকে যেতো। আমি আর জসিম ভাই ছিলাম ভাত পাগল। বেঁচে যাওয়া ভাত পান্তা করে একটু তরকারিসহ খাটের নিচে লুকিয়ে রাখতাম। পরদিন সকাল বেলা দুজনে চুপি চুপি সেই পান্তাভাত খেয়ে শুটিংয়ে যেতাম। আর সকলেই খেত রুটি। কিন্তু একদিন জানাজানি হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই বলাবলি শুরু করলো যে সকলেই একবেলা ভাত খাচ্ছে, অথচ জসিম ভাই আর ববিতা আপা দু’বেলা করে ভাত খায়। কেউ কেউ আবার রস করে বললো দু’জনেই ভাত চোর।

জসিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো খান আতা ভাইয়ের মৃত্যুর দিন এফডিসিতে। আমাকে দেখে জসিম ভাই বললেন, ম্যাডাম কী খবর? আপনার প্রডাকশন থেকে ছবি বানাচ্ছেন না? আমি বললাম, বানাবো। বলে রাখা ভাল আমার প্রডাকশনের শেষ ছবি ‘দেশী রংবাজ’-এর নায়ক ছিলেন জসিম। এরপর জসিম ভাই বললেন, ম্যাডাম উত্তরায় একটা বাড়ি বানালাম, বাড়িটা দেখতে একদিনও এলেন না। সত্যি কথা বলতে কী যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই তো গেলাম, যখন জসিম ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। জসিম ভাইবিহীন তার নতুন বাড়ি দেখতে হলো তাকে হারানোর বেদনা আর কান্নাভেজা চোখে।


মন্তব্য করুন