Select Page

‘হাওয়া’ এবং স্বর্পরাজ ঝন্টু স্যারের সিনেমা

‘হাওয়া’ এবং স্বর্পরাজ ঝন্টু স্যারের সিনেমা

হাওয়া’ ২৫-৩০ বছর আগে নির্মিত হলে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু স্যারের সিনেমাই হতো। আর ঝন্টু স্যারের সিনেমা এই সময়ে নির্মিত হলে ‘হাওয়া’র মতোই হতো

শুরুতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি

‘পরাণ’-এর দূর্দান্ত গ্যাম্বলিং ও মনোপলি দিয়ে সফল বাণিজ্য আর ‘দিন দ্য ডে’র বিপক্ষে নানামুখী ষড়যন্ত্রের পরও ঠিকঠাক হলে টিকে যাওয়ার মতো সফলতার পর বাংলাদেশি সিনেমার আকাশে ঝলমলে সূর্য হয়ে দেখা দিয়েছে ‘হাওয়া’ সিনেমাটি। ঢাকাই সিনেমার এমন সুন্দর সময় গত ১০-১৫ বছরে দেখা যায় নি। যদিও এই সফলতার মূল ক্রেডিট অবশ্যই পাবে এজেন্সির প্রমোশনাল টিম।

বাংলাদেশে বহু বছর ধরে ‘ধর পেরেক, মার বাড়ি’ টাইপ বাজেটহীন প্রমোশন নামক ভুল বাণিজ্যিক ভাবনাকে জোরছে ধাক্কাটা মারতে পেরেছে এজেন্সিগুলো। যদিও সন্দিহান, তাতে কেউ কিছু শিখেছে কিনা। পণ্যের রূপ-স্বাদ মূলত একই থাকে। কিন্তু তাকে উপস্থাপন এবং পৌঁছে দেয়ার আধুনিক রীতিকে যদি আজকের প্রযোজকরা গ্রহণ করে তবে এই সফলতা অব্যহত থাকবে।

এবার হাওয়া নিয়ে কথা হোক

সবার আগে কথা বলতে হবে ভিডিওগ্রাফি নিয়ে। এরচেয়ে ভালো অসম্ভব। একে তো অথৈ জল, তার উপর এতগুলো চরিত্র। আন্তর্জাতিক টপক্লাস ফেস্টিভলে সিনেমাটি সেরা চিত্রগ্রাহক/চিত্রগ্রহণ ক্যাটাগরিতে অসংখ্য পুরস্কার পাবার হুমকি দেয়ার যোগ্যতা রাখে। এরপর অবশ্যই বলতে হবে লাইটিং এর কথা। নদী/সমুদ্রে খোলা আকাশের নিচে দিন কিংবা রাতের মিড ক্লোজ/ ক্লোজ শট তবু না হয় নেয়া গেল। কিন্তু মিড লং বা লং শটের জন্য ম্যাজিক প্রয়োজন। লাইটিংয়ের এই ম্যাজিকটা সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমে দূর্দান্তভাবে ছিল। অবশ্য নির্মাতা সুমনের বিজ্ঞাপন বানাবার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এখানে মূল খেলাটা খেলেছে।

এই সিনেমার আরো একটি চ্যালেঞ্জ ছিল ফ্রেমের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে। জল ও মরু দুটোই স্ক্রিনের জন্য রিস্কি বিষয়। ক্যারেক্টারের পেছনে বিশাল ফাঁকা অংশ, দেখতে দেখতে যে কোন সময় দর্শক ধাঁধায় পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। না থাকে রেফারেন্স, না ডেপথ। এই চ্যালেঞ্জ সফলভাবে উৎরে গেছেন ক্যামেরাম্যান ও নির্মাতা।

অভিনয়ের কথা বলতে গেলে প্রথমের বলবো আর্টিস্ট সিলেকশনের কথা। জোর করে কাউকে নিতে হয়নি। রাজ বাদে বাকিরা বোধহয় থিয়েটারকর্মী। ফলে নৌকাটিকে মঞ্চ বানিয়ে দুর্দান্ত স্টেজ পারফরমেন্স দেখিয়েছে তারা। বিশেষ করে ‘গুলতি’ নৌকায় উঠার পর সবগুলো চরিত্রের ব্যাক টু ব্যাক ডায়লগ এবং পজিং চমকে দেবার মতো। আমার জন্য এখানে দুটো নতুন মুখ ছিল চমক। একজন শুকনা চশমা পড়া। আরেকজন মোটা করে করে, একচোখে বোধহয় সমস্যা। এতগুলো চেনা মুখের ভিড়ে, তারা কখনো হারিয়ে যায়নি বা মলিন হননি। এটাই একজন জাত শিল্পীর শক্তি। অন্যদিকে চঞ্চল চৌধুরীর ভাঙ্গা গলার ডায়লগ ডেলিভারি গতানুগতিকতাকে ভেঙ্গেছে দুর্দান্তভাবে। ‘পরাণ’-এর মনোপলি গেম দিয়ে রাজ আগামী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের স্বপ্ন দেখলেও, চঞ্চলের দুর্দান্ত পারফরমেন্স ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (খলনায়ক)’ এর স্বপ্ন ধাক্কা খেয়ে গেছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এর বাইরে যারা ছিল তারা ন্যাচারাল অভিনয় করে সিনেমাটিকে জ্বলজ্বলে রেখেছে।

রাস্তায় সাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বেদেনী দেখেছেন নিশ্চয়ই। তেলতেলে টানা শরীর নিয়ে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায় তারা হাতে সাপ নিয়ে। আপনি তাদের কখনো দেখবেন না মাথা নিচু করে চলতে কিংবা নত স্বরে কথা বলতে। এক অদ্ভুত তেজস্বী তাদের পুরো লুকআপে থাকে সব সময়। ‘হাওয়া’তে নাজিফা তুষি কখনো সে ব্যাক্তিত্বের কাছাকাছি গিয়েছে, কখনো ফসকে গেছে। তবে তিনি যে আবেদনটা চোখে-ঠোটে তুলে ধরতে চেয়েছেন সেখানে তিনি সফল। এখন পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া সিনেমার বিচারে আগামী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মিম এবং তুষির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, যদি না উর্দি বয়ফ্রেন্ডরা একপক্ষে প্রভাব বিস্তার না করে।

সিনেমার গানগুলোর কোন আবেদন পাইনি। এমনকি ভাইরাল হওয়া ‘সাদা-কালা’ গানও বিশেষ ভালো লাগেনি। এটাও লাইম লাইটে এসেছে ‘বড় ছেলে’ নাটকের মতো এজেন্সির মাইন্ডগেম কারিশমায়। তবে গানটির ভিজুয়্যাল বা ক্যামেরার কাজ অসাধারণ।

এবার ফিরি লেখার শিরোনামে

সিনেমার গল্পে কী আছে! আসলে কী দেখানো হয়েছে! সিনেমাতে নায়িকার চরিত্র এবং গল্প একদিকে যেমন দাদী-নানীর কাছে ছোটবেলায় শোনা মিথ বা রূপকথার গল্পের চরিত্র এবং কল্পকাহিনি। অন্যদিকে স্বর্পরাজ দেলোয়ার জাহান ঝন্টু স্যারের অসংখ্য সাপের কাহিনী নির্ভর সিনেমার এই সময়ের রূপায়ন। ‘হাওয়া’ সিনেমাটি ২৫-৩০ বছর আগে নির্মিত হলে ঝন্টু স্যারের সিনেমাই হতো। আর ঝন্টু স্যারের সিনেমা এই সময়ে নির্মিত হলে ‘হাওয়া’র মতোই হতো। অর্থাৎ সময়ের চাহিদা সফলভাবে পূরণ করা। অন্যদিকে অসংখ্য ভিনদেশি সিনেমাতে আমরা দেখেছি ব্যাংক ডাকাতি বা গুপ্তধন পাওয়ার পর যে সমাপনীটা নেমে আসে অংশগ্রহণকারী সবার মাঝে, এখানে সে থিমটাকেই নেয়া হয়েছে।

আর হ্যাঁ, সিনেমার চরিত্রগুলো অবশ্যই গালিগালাজ ডিমান্ড করে। তবে কখনো কখনো অযচিত বা আরোপিত মনে হয়েছে। অতিরঞ্জিত ব্যপারটা অতি আবেগে হয়ে গেছে কিনা কে জানে!

সর্বোপরি ‘হাওয়া’কে বলা যায় সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। আবার বলা যেতে পারে মাইথোলজিক্যাল থ্রিলার। আবার চাইলে রিভেঞ্জ ড্রামাও বলতে পারেন। একটি সিনেমার এতগুলো রূপ ‘গুলতি’ মতোই রহস্যময়।

দূর্দান্ত ক্যামেরার কাজ, লাইটিং আর অভিনয় দেখতে চাইলে ‘হাওয়া’ পছন্দের তালিকায় রাখতে পারেন।

জয় হোক বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নির্মাতা, লেখক ও উদ্যোক্তা .... “নিজের টাকায় টিকিট কেটে সিনেমার দেখি অধিকার নিয়ে দেই তালি বা গালি”

মন্তব্য করুন