Select Page

জানোয়ার জানতে ‘জানোয়ার’ দেখা

জানোয়ার জানতে ‘জানোয়ার’ দেখা


ওয়েব ফিল্ম – জানোয়ার
পরিচালক – রায়হান রাফী
অভিনয় – তাসকিন রহমান, রাশেদ মামুন অপু, জামশেদ শামীম, আর এ রাহুল, এলিনা শাম্মী, ফরহাদ লিমন, আরিয়া আরিত্রা, মুনমুন আহমেদ প্রমুখ।
মুক্তি – ১৪ জানুয়ারি ২০২১
প্ল্যাটফর্ম – সিনেমাটিক

জুলিয়া ক্রিস্তেফা নামের একজন সাহিত্য তাত্ত্বিক ধর্ষণ ও পুরুষ কামনা নিয়ে একটা জটিল অথচ সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। পুরুষ অনেক সময়ই কামনার বিপরীতে নারীকে, নারীর শরীরকে দায়ী করে কিন্তু জুলিয়া দেখিয়েছেন পুরুষ নিজেই দায়ী। পুরুষের নিজস্ব শারীরিক গঠন যেমন আলাদা তেমনি যৌনাঙ্গও আলাদা। জুলিয়া সারপ্রাইজিংলি পুরুষের যৌনাঙ্গ যাকে ‘পুরুষাঙ্গ’ বলা হয় তাকে অস্বাভাবিক বলেছেন। তিনি এটিকে শরীরের একটি অতিরিক্ত অঙ্গ বা ‘মাংসের উত্থান’ বলেছেন। এই অতিরিক্ত মাংসের জন্য কামনায় নীল হওয়া পুরুষেরা নিজেদের ধরে রাখতে পারে না ফলে অপরাধ করে বসে আর দোষ দেয় নারীর। নিজেদের ধরে না রাখা অপরাধী সেইসব পুরুষদের ‘জানোয়ার’ বলাই শ্রেয়।

ওয়েব প্ল্যাটফর্ম ‘সিনেমাটিক’ অ্যাপসের নতুন কনটেন্ট ‘জানোয়ার’ মুক্তি পেলো আজ। সত্য ঘটনা অবলম্বনে ফিল্মটি পরিচালনা করেছেন রায়হান রাফি।
‘জানোয়ার’ শব্দটি আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হিন্দিতে পশুদের ‘জানোয়ার’ বলা হয় কিন্তু ওয়েব ফিল্ম ‘জানোয়ার’-এ মানুষরূপী নরপশুকে ‘জানোয়ার’ বলা হয়েছে যারা দেখতে হুবহু মানুষের মতো কিন্তু ঘৃণার পাত্র। সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেইসব জানোয়ারদের চিত্র আছে এ ফিল্মে।
সুখী একটি পরিবার। বাবা থাকে দেশের বাইরে। মা তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকে। ছোট্ট মেয়েটির জন্মদিন রাত বারোটা বাজলেই। কখন বারোটা বাজবে এ নিয়ে অস্থির সে। বারোটা কি তবে বাজবে নাকি তাদের সবার জন্য অপেক্ষা করছে অন্য কিছু?

এটি গল্পের প্রথমার্ধ্ব। দ্বিতীয়ার্ধ্বে যেতে দর্শক হিসেবে আপনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে আপনি কতটুকু দেখতে পারবেন ফিল্মটি। দেখতে দেখতে যদি সত্য ঘটনার রেশটা ধরে ফেলতে পারেন তবে আপনার জন্য আরো ট্র্যাজেডির হতে পারে দেখাটা। আর যদি শক্ত মনের দর্শক হয়ে থাকেন তবে আপনি শেষ পর্যন্ত দেখতে পারেন আপনার মানসিক শক্তিতে।

‘sadness ছাড়া profundity আসে না’
– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক বিভূতিভূষণ এ কথাটি সাহিত্য সম্পর্কে বলেছিলেন। যেহেতু শিল্পের যে কোনো শাখাই সাহিত্যগুণ ধারণ করতে পারে তাই ‘জানোয়ার’ ফিল্মটিও এই সাহিত্যগুণ ধারণ করেছে। এটিতে ‘sadness’ প্রচণ্ড পরিমাণে আছে তাই ‘profundity’ বা গভীরতাও অনেক। বুকে পাথর বেঁধে ফিল্মের শেষ আধঘন্টা আপনাকে দেখতে হবে। হয়তো আপনি চোখে জলও আবিষ্কার করতে পারেন। যে পরিবারটির কথা বলা হলো তাদের সাথে কি ঘটেছিলো শেষ পর্যন্ত এটা যতক্ষণ দর্শক দেখবে তাদের মনে ‘sadness’ প্রচণ্ডভাবে তৈরি হতে পারে এবং গভীরতা সেখানেই চলে আসবে।

পরিচালক রায়হান রাফী ‘জানোয়ার’ নামের যে সার্থকতা সেখানে সফল। তিনি একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষকে জানোয়ারসুলভ দেখিয়েছেন। দেখতে দেখতে এদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা তৈরি হবে। দর্শকের কখনো মনে হবে এতটা খারাপ মানুষ কি হতে পারে আবার বাস্তবতার সাথে মেলালে যখন সামঞ্জস্য খুঁজে পাবে অনায়াসে বলে দেবে জানোয়াররূপী পুরুষ মূলত এমনই হয়। পরিচালক ঘৃণার মাধ্যমে সামাজিক বাস্তবতা ও সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছেন।

অভিনয়ের কথা বললে সব চরিত্র মন দিয়ে অভিনয় করেছে। পুলিশ অফিসার চরিত্রে তাসকিন রহমানের ইউনিক স্টোরি টেলিং আর স্যাড এক্সপ্রেশনগুলো জাস্ট অসাম। রাশেদ মামুন অপু ভয়ঙ্কর, তার চোখ কথা বলে। জামশেদ শামীম, আর এ রাহুল, ফরহাদ লিমন সবাই জানোয়াররূপী পুরুষের চরিত্রে মিশে গেছে। এলিনা শাম্মী যথেষ্ট প্রতিভাময়ী তার অভিনয় সেটাই বলে। শিশুশিল্পী আরিত্রার কিউট অভিনয় দর্শকের মন ভালো করে দেবে আবার তার জন্য দর্শকের চোখের জল ঝরবে। মুনমুন আহমেদ নামের মেয়েটিও প্রমিজিং। ছোটভাইয়ের চরিত্রে থাকা ছেলেটির এক্সপ্রেশন লেভেল বেস্ট ছিল সবার থেকে। তাকে ম্যানেজ করতে পারাটাও ছিল পরিচালকের ক্রেডিট। ভিকটিমের চরিত্রগুলোকে এ চারজন একদম জীবন্ত করেছে। অবশ্যই তারা প্রশংসার দাবিদার।

কারিগরি দিকের কথা বললে প্রথমেই আসে এর স্টোরি টেলিং। যে চরিত্রগুলো তাদের গল্প বলছে তাদের প্রত্যেককে ফ্ল্যাশব্যাকে টেকনিক করে তুলে ধরেছেন পরিচালক। দর্শক প্রথমত বুঝে উঠতে পারবে না কিন্তু দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে বুঝে যাবে। স্টোরি টেলিং-এ চরিত্রগুলো মনোলগ ব্যবহার করেছে। সিচুয়েশন অনুযায়ী ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক পারফেক্ট ছিল। হাসাবে, কাঁদাবে ঠিক তেমনই ছিল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। ইনডোর লোকেশনে পুরো ফিল্ম গুরুত্ব পাওয়াতে ক্যামেরা সেভাবেই কথা বলেছে এবং রায়হান রাফি একজন কাজ জানা নির্মাতা সেটারই ছাপ আছে। ব্রুটালিটি ফিল্মে এমনভাবে এসেছে যে সিচুয়েশনই সেটা তৈরি করেছে সরাসরি না দেখিয়েও। এমনকি পরিচালকের প্রতিও দর্শকের ঘৃণা আসতে পারে অমানবিকতা দেখে যা বাস্তবে ঘটেছে। এই সিচুয়েশন তৈরির দক্ষতাও একজন পরিচালকের গুণ।

ধর্ষণ, নারীর প্রতি যে কোনো ধরনের নির্যাতন ইত্যাদি ঠেকাতে পুরুষের বিরুদ্ধে পুরুষকেই দাঁড়াতে হবে তাহলে এসব বন্ধ হবে। পুরুষ যখন পুরুষের বিরুদ্ধে যাবে পুরুষের নপুংসক মানসিকতা থাকবে না। ‘জানোয়ার’ ওয়েব ফিল্মের পোস্টারে ব্যবহৃত শ্লোগান ‘জানোয়ার দেখতে হুবহু মানুষের মতোন’/’মানুষ সেজে জানোয়ার আসে খুঁজে দেখো তোমারি আশেপাশে,/’চেনা চেহারার নিচে জানোয়ার হাসে’ এভাবেই সচেতনতা তৈরি করবে। সামাজিক আন্দোলনের একটা পদক্ষেপ হয়ে থাকল ‘জানোয়ার’ ফিল্ম। এটি ২০২১ সালের প্রথম সেরা কাজ হয়ে থাকল।

জানোয়ার জানতে ‘জানোয়ার’ দেখুন।
‘জানোয়ার’-কে ‘না’ বলুন।

রেটিং – ৯/১০


মন্তব্য করুন