Select Page

বিশ্বাস্যযোগ্য নির্মাণ ‘১৯৭১ সেই সব দিন’

বিশ্বাস্যযোগ্য নির্মাণ ‘১৯৭১ সেই সব দিন’

সময় থাকলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখে নিতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেই সময়ের কিছু পরিবার এবং তাদের মধ্য দিয়ে সমাজ, দেশের মানুষের গল্প বলা ‘১৯৭১: সেই সব দিন’…

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাম্প্রতিককালে বেশকিছু সিনেমা বানানো হলেও নতুন জেনারেশন বা আধুনিক দর্শকদের রুচি বা পছন্দ-অপছন্দ মাথায় রেখে স্মার্ট সিনেমার সংখ্যা খুবই নগন্য। সর্বশেষ মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল নাসিরউদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত ‘গেরিলা’। বেশ কয়েক বছরের গ্যাপ দিয়ে গতবছর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘দামাল’ও এসেছিল আলোচনা। প্রশংসায় এবার একই পথে হাঁটছে চলচ্চিত্রে নবাগত নির্মাতা হৃদি হকের ‘১৯৭১: সেই সব দিন’

ট্রেলার-গান ও হৃদি হকের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার দেখে-শুনে সিনেমাটি দেখার যে আগ্রহ জন্মেছিল সেটা প্রত্যাশার মাপকাঠিতে শূন্যতে নামিয়ে নিয়ে সিনেমাটি দেখেছি মিরপুর সনি স্কয়ারে। একান্ত ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বলছি বা লিখছি ‘পুরো সিনেমা শেষে মন ভারী হয়ে আসা একটা অনুভূতির সাথে চোখের কোনে পানি নিয়েই প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়েছি…।’

এখন অনেকেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কমেন্ট করতেই পারেন যে, কী এমন আহামরি সিনেমা এটা! হ্যাঁ, আমিও বলছি- হৃদি হক কোনো মাস্টারপিস বানিয়েছেন এমনটা একদমই নয়। বেশকিছু বিষয় নিয়ে একটু আক্ষেপ বা হতাশা থাকলেও পুরো সিনেমা দেখার পর সেসব অনেক কিছুই হালে পানি পায় না গল্প, চিত্রনাট্যের বুনন ও মেকিং মুনশিয়ানার কল্যাণে; অন্যসব বাদ দিলে শুধু হৃদি হক ও ক্যামেরার সামনে-পেছনে থাকা পুরো টিমের অসাধারণ বোঝাপড়া এবং যার যার জায়গায় সৎ থেকে পরিপূর্ণ যত্ন এবং যথাসাধ্য রিসার্চ করে বানানো এই সিনেমা ২০২৩ সালে এসে ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল ৯টি মাসের টুকরো টুকরো ছবিই স্ক্রিনে বিশ্বাসযোগ্যভাবেই উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে গেলো অসাধারণ নৈপুণ্যেতায়।

এই সিনেমা দেখার সময় জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ ও হুমায়ূন আহমেদের ‘জোৎস্না এবং জননীর গল্প’ নামের উপন্যাসের কিছু অংশের সাথে মিল পেয়েছি। এবং সেই মিল থাকাও স্বাভাবিক, উদাহরণ হিসেবে – ১৯৭১ এর মার্চে টিক্কা খান গর্ভনর হিসেবে যে এসেছিলেন সেই সময়ে সেটা তো ইতিহাসেই লিপিবদ্ধ। তাই সময়কে তুলে ধরতে ইতিহাস তো আনতেই হবে। তবে সিনেমার গল্প বোরিং করেনি এক মুহূর্তের জন্যও এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তির।

একাত্তরের সেই উত্তাল সময়ে তৎকালীন ঢাকা (Dacca) শহরের শান্তিবাগ এলাকার ১৭ নাম্বার বাড়িতে থাকা একটি যৌথ ফ্যামিলির মানুষের গল্প নিয়েই এই সিনেমা। সাথে পাশের বাড়ির একটি হিন্দু পরিবারও গুরুত্ব পেয়েছে গল্পে। ১৭ নাম্বার বাড়ির তিন ছেলে তাদের স্ত্রীরা দেশকে নিয়ে ভাবে ভিন্নভাবে। স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে তাদের যুক্তিও আছে। তবে একটা সময় সেইসব কিছু ছাপিয়ে জীবন বাঁচানোই যখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সাথে দেশ স্বাধীনের জন্য সবকিছু তুচ্ছ করে যুদ্ধে নাম লেখানো সবই এসেছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। মাল্টিস্টারার এই সিনেমায় ভালো লাগার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিটি চরিত্রই স্ক্রিন টাইম কম থাকুক বা বেশি গল্প এবং চিত্রনাট্যতে আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

যুদ্ধের সিনেমার নারী চরিত্রগুলো নিয়ে সাধারণত একই ফরম্যাটে উপস্থাপনের প্রথাও ভেঙেছেন হৃদি হক। দাদী, মা, বিথী, বিন্তি, দোলন, নন্দিনী, নায়লা, শান্তি, টিংকু প্রতিটি চরিত্রই যেন এই সময়ে এসেও খুব উজ্জ্বল, খুব বাস্তব। অন্যদিকে সঞ্জু, রঞ্জু, রায়হান, সজীব থেকে শুরু করে লন্ড্রির রাশু নামের ছেলের চরিত্রটিও তো ছাপ রেখেছে যার যার জায়গা থেকে। মামুনুর রশীদ, আবুল হায়াত, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পী সরকার অপু, আনিসুর রহমান মিলন, ফেরদৌস, হৃদি হক, সজল, সানজিদা প্রীতি, তারিন, লিটু আনাম, নাজিয়া হক অর্ষা, মৌসুমী হামিদ, সাজু খাদেম, জয়িতা, সোনিয়া হোসেন, জুয়েল, সোহান, মুনমুন আহমেদ, ফারহানা হামিদ সহ অসংখ্য প্রতিভাবান এবং আলোচিত শিল্পীদের দেখা গেছে এক সিনেমায়। এটাই কি কম পাওয়া!

হ্যাঁ, এই সিনেমা নিয়ে আক্ষেপের অন্যতম কারণও এটি। এতোগুলো চরিত্রের সবগুলোই ঠিকঠাক এন্ডিং পায়নি। আবার প্রতিটি চরিত্রই যে সাবলীলভাবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পেরেছে তেমনটাও নয়। সেটা করা গেলে হয়তো আরো অনেকটা বেশি কানেক্ট করতে পারতো দর্শকেরা এই সিনেমার সাথে। তবে ভালো কিছু উপহার দেবার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে সবার মাঝেই।

অসাধারণ শ্রুতিমধুর বেশকিছু গানের দেখা ও শুনতে পারার অভিজ্ঞতা হয়েছে এই সিনেমায়। বিশেষ করে ‘যাচ্ছো কোথায়’ পছন্দের শীর্ষে থাকবে। কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও সিনেমা দেখার সময় মনে হয়েছে যে, উর্দু ভাষার ’ইয়ে শামে’ নামক গানটি আসলেই সিকোয়েন্স এর চাহিদার কারণে স্থান পেয়েছে সিনেমায়। যুদ্ধের সিনেমায় বাজেট ও নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ভিএফএক্স মন্দ হয়নি।

‘১৯৭১: সেই সব দিন’ এর সবচেয়ে পজিটিভ দিক এর মেকিং, সেট, কালার গ্রেডিং, কস্টিউম, বিজিএম, মেকআপ, সিনেমাটোগ্রাফি, আর্ট ডিপার্টমেন্ট প্রতিটা ক্ষেত্রেই হৃদি হক এবং তার টিম লেটার মার্কস পেয়ে পাস করেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্ক্রিনে একটি বারের জন্যও মনে হবে না এটা একাত্তর সাল নয়। যে বাড়ি-গাড়িগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার। এমনকি শান্তিবাগ নামের যে এলাকা দেখানো হয়েছে সেটাও মুগ্ধতাই ছড়িয়েছে স্ক্রিনে। প্রতিটি আলাদা আলাদা বাসার সেই সময় ধরে রাখা ফার্নিচার থেকে রাস্তার দেয়ালে লেখা স্বাধীনতার শ্লোগান সবমিলিয়ে কে বলবে এটা হৃদি হকের প্রথম সিনেমা! নির্মাতা হিসেবে প্রথম সিনেমাতেই রীতিমতো বাউন্ডারি হাঁকালেন তিনি।

প্রথম সিনেমা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং বিষয় বেছে নিলেও নিজের বাবার লেখা গল্প হৃদি হক যে নিজের অন্তরে ধারণ করেছেন পরম মমতায় তার প্রমাণ এই সিনেমা। সময় থাকলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখে নিতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেই সময়ের কিছু পরিবার এবং তাদের মধ্য দিয়ে সমাজ, দেশের মানুষের গল্প বলা ‘১৯৭১: সেই সব দিন’।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

মন্তব্য করুন