Select Page

‘ক্যাফে ডিজায়ার’ যার নাম বাসনাপুর বা বাসনাতলা হতে পারত

‘ক্যাফে ডিজায়ার’ যার নাম বাসনাপুর বা বাসনাতলা হতে পারত

চরকিতে যখন ‘ঊনলৌকিক’ দেখতে বসি, অস্বীকার করব না যে শিবব্রত বর্মণের কাহিনির লোভে, বা নামের মাহাত্ম্যে দেখতে বসেছি। বন্ধুকৃত্য হিসাবে কেউ দেখতে চাইলে দেখতে পারেন। ঝগড়া করব না। যেসব মহৎহৃদয় এখনো ভাবেন যে গুণে-মানে-অনন্যের চোটে লোকে কালচারাল এবং/বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রডাক্ট সেবন করেন, তাঁদের প্রতি আমার আর মায়াও কাজ করে না। পুস্তকের দুনিয়ায় এটা আমি বহুকাল ধরে বলে আসছি। দৃশ্যের দুনিয়ার নিয়মও ভিন্ন কিছু নয়। আমরা দেখতে বসি কোনো না কোনো পূর্ব যোগাযোগের রেশ ধরে, কিংবা র‌্যান্ডাম। তার থেকেও বড় কথা, অন্য ‘কাজ থেকে অবসর’ নেবার সুযোগ পেলেই কেবল। তার মধ্যে চ্যানেলের বিস্তার ও চিত্রের পরিমাণ … আর সহজ নাই!

এ দফা দেখতে বসলাম রবিউল আলম রবির কাজ হিসাবেই। তাঁকে ধন্যবাদ, সুযোগ করে দেবার জন্য। ‘ক্যাফে ডিজায়ার’ ঝকঝকে দৃশ্যোৎপাদ/ভিজ্যুয়াল প্রডাক্ট, পরিমিত ও স্মার্ট সাউন্ড-প্রডাক্ট, মনোরম ও আরামদায়ক/স্মুদ গতির একটা ছায়াছবি। মফস্বল ও প্রান্ত এসেছে কোনোরকম জবরজং বা গঁৎবাধা চিত্রকল্প ছাড়াই, অথচ মফস্বলের স্বাতন্ত্র্যসমেতই। মোটের ওপর সু-অভিনীত; এবং অতিশয় কলিজা-কাঁপানো একটা সমাপনী গানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। খুন-খারাপি, দৌড়াদৌড়ি, অস্থিরতা আর কড়া ক্রাইমপ্রবণতার দৃশ্যগল্পের রমরমা গড্ডালিকার মধ্যে সফটকোর নির্মাণ। নির্মাতা প্রজ্ঞাপনেও সেটা বলেন। সব মিলে রুচিবদলের জন্য ভালো ডিশ।

এটার নাম ‘বাসনাপুর’ বা ‘বাসনানগর’, এমনকি ‘বাসনাতলা’ হলে মরহুম মুনীর চৌধুরী রাগ করতেন বলে মনে হয় না (টেনেসি উইলিয়ামস-এর ‘স্ট্রিট কার নেইমড ডিজায়ার’ নাটকের বাংলানুবাদ করেছিলেন তিনি ‘গাড়ির নাম বাসনাপুর’)। তবে হয়তো নির্মাতা ও প্রযোজক পক্ষের গ্লোব্যাল বাসনা খর্ব হতো। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি সেগুলোই ভাল নাম হতো।

পাঁচটা ‘অবৈধ’ বা সমাজ-’অসঙ্গত’ (যৌন) কামনা-বাসনার (শব্দ দুটোকে এই মুল্লুকে এখন যৌনতার বাইরে আর ব্যবহার করাই মুস্কিলের হয়ে গেছে, যদিও জন্মদিনে কামনা জানানোর আগে শুভ কথাটা লিখে চালিয়ে নেয়া হয়) স্বতন্ত্র গল্প নিয়ে এই ছায়াছবি। গল্পগুলোকে একটা দুটো চরিত্র দিয়ে জুড়ে দেয়া হয়েছে। হাইপারলিংক না কী যেন নামে ডাকে। ডাকুক! ওই জুড়ে না দিলেও সমস্যা হতো না; জুড়ে দেয়াও সব জায়গায় অত মসৃণ হয়নি (যেমন বীথির বাপ খামোকা ইমরুলের মুস্কিল-আসান লোকটার বাড়ি ঢোকেন)।

পাঁচটা হেটারোসেক্সুয়াল কামনাতেই কমবেশি তিনজন করে কোনো না কোনোভাবে আছেন। আর আছেন বলেই তা ‘অবৈধ’; আছেন বলেই তা আকর্ষণীয়।

গল্প পাঁচটার আড়াইখানা খুব স্মার্ট। বাকি আড়াইখানা ভ্যাদভ্যাদা। গরিব বীথি ময়মনসিংহ বাইকওয়ালা বড়লোক নাগরিক স্মার্ট শাফায়েতকে পাবার লোভে দৌড়াদৌড়ি করেন সেটা মনোহর, বেদনা-সৃষ্টিকারী। কিন্তু তিনি যে স্টপঘড়ি সমেত দৌড়ান সেটা ভ্যাবদা ধরনের দৃশ্য সংযোজন। দর্শকদের গল্প বোঝার দক্ষতার বিষয়ে বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি সমেত আগায় না। বিদ্যুৎ কর্মকর্তা হায়াৎ সাহেব যে শহর আন্ধার করে সঙ্গমরচনা করেন এক নবীনার সাথে, তা চিত্তাকর্ষক। কিন্তু যেরকম রুটিন করে সেটা করা হয়ে থাকে তা পরিশেষে ডাল/ভোঁতা ফর্মুলা। দিনারের নার্ভাস ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার অনবদ্যতার পাশাপাশি এই গল্পতে আছেন আজাদ আবুল কালামের মতো শক্তিমান অভিনেতা। তা সত্ত্বেও নির্মাতাদের শিশুতোষ রুটিন প্রস্তাব এই ‘প্রণয়টা’কে দর্শকদের জন্য রুগির পথ্যের মতো পরিবেশন করেছে। আধখানা আনস্মার্ট গল্পের মধ্যে আছে পানির কল মিস্ত্রি ইমরুলের ঘ্যানঘ্যানানির ব্যক্তিত্ব। সেলিব্রিটি পিয়ার বাসায় ঢুকবার বাহানা খোঁজাটা দারুণ। কিন্তু খুঁজে পেতে লাগাতার ন্যাগিং না করেও সাটলিটি আনা যেতে পারত, আনা জরুরি ছিল। না আনতে পারার কারণে যে নতুন যৌন সম্ভাবনায় ছবিটি শেষ হয়, সেটা উদ্ভাসিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।  

ইমরান-সোমার এনকাউন্টারটি স্মার্টতম। শ্যামল দিনকে দিন ভালো করছেন। প্রীতি ঝকঝকে, আগের মতোই। ইমরানের গাড়িতে সোমা যখন অ্যাডভাঞ্চারাস মজুরিভিত্তিক যৌনচুক্তিতে যাচ্ছেন, বিজনেস-ডিল যাকে বলে, তখন ইমরানের গাড়ির কাচে ঢাকা নগরের বহির্দৃশ্যগুলো প্রতিবিম্বিত হয়। ইমরান ও সোমা, যদিও খুব বেশি পরিপাটি সংলাপ, তবুও দারুণভাবে পরস্পরের প্রতি উদ্ভাসিত হতে থাকেন। সোমা যখন ইমরানেরই চুক্তিতে অন্য কারো সাথে ‘রাত কাটাতে’ হোটেলে পৌঁছান, অস্পষ্ট অসংজ্ঞায়িত বেদনায় ইমরান তখন তাঁকে বিদায় দেন। বাসনার যেন বা অচেনা অর্থে দর্শকেরা বেদনার্ত বোধ করেন।

প্রণয়ের বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে মনুষ্য মস্তিষ্ক সামান্যই দুশ্চিন্তিত থাকে। যা ও যতটুকু থাকে তা হলো বিধি বা নিয়ম। পোর্টালগুলোর পরিচালক/নির্বাহীবৃন্দ মনুষ্য কল্পনা ও সামর্থ্যের বিষয়ে আরো আস্থাবান হলে ভাল হয়। যৌনতা ও তার কারিগরি নিয়ে তীক্ষ্ণ ছায়াছবি বানানোর লোক নিশ্চয়ই আছেন, যেমন আছেন রবি নিজেই; কিন্তু তার আগে পোর্টালগুলোর বিশ্বাস করতে পারতে হবে যে দেখারও দর্শক আছেন। এবং দর্শক কোনো অপরিবর্তনীয় জড়বস্তু বিশেষ নহেন। আপনি প্রস্তুত হতে থাকলে, ইঁহারাও প্রস্তুতই হতে থাকবেন।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন