Select Page

কাওসার আহমেদ চৌধুরী: যেখানে সীমান্ত তোমার…

কাওসার আহমেদ চৌধুরী: যেখানে সীমান্ত তোমার…

আমি স্মৃতিকাতর মানুষ। দিন-তারিখ-ক্ষণ একবার যদি মস্তিষ্কে পোক্ত জায়গা করে নিতে পারে, সহজে ভুলতে পারিনা। অবশ্য এটি খারাপ কিছু না। বদভ্যাস হলো, আমার সামনে অংক কিলবিল করলে আমি আপন মনে যোগ-বিয়োগ করতে থাকি। কেউ যদি বলেন, তার জন্ম তারিখ ০১-০১-২০১১ তে। আমি অবচেতনভাবেই ১+১+২+১+১=৬ অংক কষে ফেলি। আবার ধরুন, হোটেলে আমার রুমের নম্বর ৫০৭। অবচেতন মনেই আমার সামনে চলে আসে ৩ সংখ্যাটি (৫+০+৭=১২; ১+২=৩)। আমার ভেতর সংখ্যাতত্ত্বের ভাইরাস প্রবেশ করেছেন যিনি, তিনি কাওসার আহমেদ চৌধুরী। কে জানতো, প্রকৃতি ২.২.২২ এই বিশেষ দিনটিকেই তার প্রয়াণের দিন হিসেবে বেছে নেবে! ২০০৫ সালে একবার তার বাসায় গিয়েছিলাম বন্ধু ইমনকে নিয়ে। ইমন তখন সবে মডেলিং শুরু করেছে। ব্যক্তিগত বেশ কিছু বিষয় নিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে দ্বিধান্বিত। জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে চর্চা করা অন্যরা কেমন হয় আমরা জানিনা, তবে কাওসার আহমেদ চৌধুরী সবার সাথে বন্ধুর মত আচরণ করতেন। ইমনকে বলেছিলেন, আগামী বছরই তো সিনেমা করবা মিয়া। টিকেট দিও। আর আমাকে বলেছিলেন, পত্রিকায় নায়ক-নায়িকার ঘরগেরস্তির গল্প আর কত করবা, এবার নাটক/ সিনেমা লিখো আর আমারে ‘পার্ট’ দিও। বিস্মিত হয়েছিলাম এই ভেবে, ঠিক তার আগের দিনই আমি ‘বৃষ্টির পরে’ নাটকের গল্প লিখেছিলাম। আর ইমন তার পরের বছরই ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পায়।

প্রায়ই ফেসবুকে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সাথে কথা হতো। তিনি কত বিশাল মনের এবং অসাধারণ গুণী একজন মানুষ, কখনো বুঝতে দিতেন না। আমরা বুঝিয়ে দিলেও বিনয়ে সংকুচিত হয়ে যেতেন। ভীষণ আবেগী এই মানুষটি হয়তো কখনো ইনবক্সে তার ছেলে প্রতীকের মেয়ে তৃয়ার খেলার ভিডিও শেয়ার করে আপ্লুত হতেন। আবার ছোট ভাইয়ের নাতনী হবার ভিডিও বার্তা দ্বিগুণ উৎসাহে শেয়ার করতেন। যখনই প্রশ্ন করতাম, হাও আর ইউ? মজা করে উত্তর দিতেন, ‘মি অলসো ভেরি ফাইন’। মজার মানুষ আমার বৌভাতে এসেও ঘটিয়েছিলেন এলাহী এক কান্ড। অনুষ্ঠানের প্রথম অতিথি হিসেবে আমার এবং মিতুর বিশাল একটি ছবি এঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, যা আমি আজও সংরক্ষণ করে রেখেছি। প্রসঙ্গ যতবারই স্মরণ করেছি, এই গুণী চিত্রশিল্পী ততবারই কুঁকড়ে গিয়েছেন। ভাবখানা এমন, ‘কী-ই বা এঁকেছি, সেটি আবার সংরক্ষণ করার কি আছে?’ তবে আমার কাছে কাওসার আহমেদ চৌধুরী থেকে পাওয়া যে কোনো কথা/ উপহার-ই ছিল আশীর্বাদ।

১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও গোয়েন্দা হিসেবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। নিজেই জানিয়েছিলেন সে সময়ের অনেক কথা। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত হবেন, তার ইঙ্গিত প্রকৃতি আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর যে তার জন্মদিন। আড্ডাচ্ছলে বলেছিলেন অনেক কথা; ছোটবেলায় ম্যাজিশিয়ার হবার ইচ্ছে ছিল তার। বাবার শিকারি বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে ঘুরেছেন প্যাঁচা শিকার করার জন্য। কারণ বইয়ে পড়েছিলেন প্যাঁচার চোখ ভেজে খেলে নাকি অন্ধকারে দেখতে পাওয়া যায়। বড় হয়ে চারুকলায় চার বছর পড়াশোনা করেছিলেন। তারপর ঠিক করেছিলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। উপমহাদেশের গুণী পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সাথে পরিচয়ও হয়েছিল। তিনি তাকে পুনায় চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশোনাও করতে বলেছিলেন। তার পরিচালিত ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ তে একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে। চাকরি ও ভিসা জটিলতার কারণে সে চলচ্চিত্রে তার আর অভিনয় করা হয়নি। যদিও বেশ কয়েক বছর আগে রাফায়েল আহসান-এর ‘নয় ছয়’ চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী কবি হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তার কাছ থেকেই শুনেছি, একবার ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই কবিতা পড়ে বলেছিলেন, একটি কবিতা ছাপবেন। আরেকটি নিজের কাছে রেখে দেবেন। তখন থেকেই তিনি লিখেছিলেন অনেকগুলো কবিতা। প্রকাশিত হয়েছিল তার কবিতার বই ‘ঘুম কিনে খাই’। ১৪/১৫ বছর বয়স থেকেই মেডিটেশন করতেন তিনি। তবে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর যে পরিচয়টি আমাকে প্রায়ই আপ্লুত করে, তা হলো তিনি আমাদের দেশের একজন অসাধারণ গীতিকবি। এ প্রজন্মের অনেকেই তাকে শুধুমাত্র একজন ‘জ্যোতিষী’ হিসেবে জানেন। অথচ কালজয়ী গান ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’, ‘রূপালী গীটার ছেড়ে’, ‘মৌসুমী কারে ভালোবাসো তুমি’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’ ইত্যাদি গানের গীতিকার তিনি। ‘কবিতা পড়ার প্রহর’ গানের স্মৃতি রোমন্থণ করেছিলেন একবার। জানিয়েছিলেন গানটি লিখেছিলেন ’৭০ দশকের শেষের দিকে। সিলেটের এক চা বাগানে তার মেজ ভাই চাকরী করতেন। একবার সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন সবাই। ভাই ছিলেন না। বাগানে কাওসার আহমেদ চৌধুরী একা। এক  রাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন একটি উঁচু টিলার একদম ওপরে। দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলেন। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। সে সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়েছিল, তিনি যেন জোনাকীর ভেতর হারিয়ে গেছেন। ওই দৃশ্যটি তার মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল। ঢাকায় ফিরে সেটি কল্পনা করেই লিখে ফেলেছিলেন আস্ত একটি গান। যে গানটি ৮০’র দশকে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানের জন্য সুর করেন বরেণ্য লাকী আখন্দ। কণ্ঠে তুলে নেন শাকিলা জাফর। তারও অনেক পরে বিটিভির ‘সুর ও বাণী’ অনুষ্ঠানে গুণী শিল্পী সামিনা চৌধুরীকে দিয়ে দ্বিতীয় দফায় গানটি গাওয়ান লাকী আখন্দ। সামিনা চৌধুরীর গাওয়া গানটি সে সময় এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, কলকাতার আকাশবাণী থেকে গানটি প্রচারের জন্য কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কাছ থেকে অনাপত্তি স্বাক্ষর-ও নেয়া হয়েছিল।  

প্রকৃতির নিয়মে আমরা সবাই বিদায় নেব পৃথিবী থেকে। এটাই অমোঘ সত্যি। তবে আজ যখন প্রিয় মানুষের মৃত্যু সংবাদ ‘রাঙা সকাল’ ক্যামেরার সামনে পড়ছিলাম, সারাটি দিন এটাই ভেবেছি, জীবনকে আমরা যতটা বড় ভাবি, জীবন অত বড় নয়। সুতরাং, প্রিয় মানুষকে যা বলা হয়নি, আজই বলতে হবে। যা শোনা হয়নি, আজই শুনে নিতে হবে। প্রিয় মানুষেরা ভালো থাকুক। কাওসার আহমেদ চৌধুরী ভালো থাকুক। তার জন্য অনন্ত দোয়া, ভালোবাসা।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র সমালোচক ও উপস্থাপক। মাছরাঙা টেলিভিশনে ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য করুন