Select Page

স্বপ্নের ‘প্রিয়তমা’ কতটুকু সত্যি হলো?

স্বপ্নের ‘প্রিয়তমা’ কতটুকু সত্যি হলো?

প্রিয়তমা; গল্প: ফারুক হোসেন; পরিচালনা: হিমেল আশরাফ; অভিনয়: শাকিব খান, ইধিকা পাল (কলকাতা), লুৎফর রহমান জর্জ, শহীদুজ্জামান সেলিম, এলিনা শাম্মী, শিবা শানু, ডন, ইমতু রাতিশসহ অনেকে; প্রযোজনা: ভার্সেটাইল মিডিয়া লিমিটেড; মুক্তি: ২৯ জুন ২০২৩ (ঈদুল আজহা)

বর্তমানে আমি নানাবাড়ি পিরোজপুরে অবস্থান করছি। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের সিনেমা হল অভিরুচি, প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বরিশাল শহরে অবস্থিত। জীবনে সিনেমা দেখতে গিয়ে অনেক পাগলামো করেছি, ‘প্রিয়তমা’ দেখার জন্য আরেকবার একটু পাগলামি করলাম।

মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর হাতে গড়া ‘ভাই-ব্রাদার’ গ্রুপের অন্যতম কনিষ্ঠ ভাই বলা যায় হিমেল আশরাফকে। আশফাক নিপুণ, রেদোয়ান রনিদের মতো জনপ্রিয়তার ছোঁয়া তিনি পাননি। কাজের মানও যে তাদের লেভেলের, সেরকমও না। তবে ছোটপর্দার হিমেল আশরাফের নাটকের মাঝে একটা মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ড খুঁজে পাওয়া যায়। যে মানের ধারা বজায় ছিল তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘সুলতানা বিবিয়ানা’তেও। বাপ্পীর মতো লোক-হাসানো অভিনয় করা নায়কের কাছ থেকে তিনি ন্যাচারাল অভিনয় আদায় করেছিলেন।

‘প্রিয়তমা’ হিমেল আশরাফের স্বপ্নের চলচ্চিত্র। সেই ২০১৭ সাল থেকে তিনি গল্প নিয়ে শাকিব খান পেছন পেছন ঘুরেছেন। শাকিব যেনো কোনোভাবেই এই চলচ্চিত্রের জন্য সময় দিতে পারছিলেন না। অনেকবার অনেক কারণে প্রি-প্রডাকশন পিছিয়েছে। শেষমেষ এমন সময়ে এসে ‘প্রিয়তমা’ প্রজেক্টটা লক হলো, যখন ঈদ আসতে বাকি কেবল দেড় মাস! ঠিক দেড় মাসের মধ্যেই সবকিছু কমপ্লিট করে পর্দায় হাজির করা হলো ‘প্রিয়তমা’, হিমেল আশরাফের দ্বিতীয় সিনেমা।

শাকিব খান ইদানীং নতুন পরিচালকদের সাথে কাজ করছেন। যে নাটকের পরিচালকদের এফডিসি সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, এফডিসির হাতে গড়ে ওঠা শাকিব বর্তমানে নাটকের পরিচালকদের হাতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। এর সুফলও তিনি পাচ্ছেন। তার অভিনয়ে ভিন্নতা এসেছে। লুক-গেটআপে পরিবর্তন এসেছে। ‘প্রিয়তমা’ দেখেই বলুন, কাঁধ বেয়ে পিঠ পর্যন্ত চলে যাওয়া চুলে আপনি কি কখনো শাকিবকে দেখেছেন? তাও আবার ন্যাচারালি গ্রো করা! আজীবন শাকিব খান তার উল্টাপাল্টা মেকআপ-গেটআপের জন্য ট্রল হয়েছেন। সেই শাকিব খানকে এবার আমরা একটা নিখুঁত প্রস্থেটিক মেকআপ নিতে দেখলাম। বুড়ো বয়সের শাকিব খান দেখতে কেমন হবে, সেটা দেখলাম। এভাবে কি কখনো শাকিব খানকে দেখেছেন?

শুধু লুক-গেটআপে নয়, শাকিবের অভিনয়েও পরিবর্তন এসেছে। আগের শাকিব খান যাত্রাপালার মতো অনেক লাউড অ্যাকটিং করতো। এখনকার কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন। অভিনয়ের পিচ লো করেছেন, আন্ডারটোনে থাকার চেষ্টা করেন। এরকম শাকিব খানকে সম্ভবত ‘নবাব’-এ দেখেছেন। আর কি কোথাও দেখেছেন?

‘প্রিয়তমা’র মূল শক্তির জায়গা একটা। মূল দুর্বলতার জায়গাও একটাই। আর মজার বিষয় হলো, দুইটা একই। শাকিব খান যেমন ‘প্রিয়তমা’র একটা শক্তি, ঠিক তেমনি ‘প্রিয়তমা’র একটা দুর্বলতাও।

শক্তির জায়গাটা নিয়ে আগে বলি। শাকিব খান আগে একইসঙ্গে তিন-চার সিনেমায় কাজ করতেন। সেজন্য তার অভিনয়ের গ্রাফ সব ছবিতে একই থাকতো, উপরন্তু তিনি লুক কন্টিনিউ করতে পারতেন না। আমার এখনো মনে আছে, ২০১৬ সালে একটা চলচ্চিত্র দেখেছিলাম ‘মেন্টাল’ নামে। সেখানে গুণে গুণে চারটা ভিন্ন ভিন্ন লুকে দেখেছিলাম তাকে। সে এক আজব শাকিব খান, পর্দায় তিনি যেমন খুশি তেমন সাজেন!

এইবার ‘প্রিয়তমা’য় তিনি কোরবানির আগ পর্যন্ত আনলিমিটেড টাইম-ডেট দিয়েছিলেন। তিনি এখন ধরে ধরে একটা ছবিতে মনোযোগ রাখেন। নিজেকে চরিত্র অনুসারে গড়ে তোলেন, ওভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করেন। তার সুবিশাল জনপ্রিয়তা, স্বাভাবিকভাবেই সিনেমা চলে যায় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।

দূর্বলতার জায়গাও সেজন্যে তিনি। তার এই সুবিশাল ফ্যানবেজকে যদি সিনেমাহলে সন্তুষ্ট করতে হয়, তাহলে গল্পের ভেতর মাস মোমেন্ট রাখতে হবে, হিরোইজম রাখতে হবে। দু-চারটা ফাইট রাখতে হবে, কমেডি রাখতে হবে। এগুলো করতে গিয়ে প্রায় সময়ই মূল গল্পকে ছেড়াফাটা করতে হয়। এই কাজটা সব পরিচালক-চিত্রনাট্যকার করতে পারে না। যে করতে পারে, সে-তো একদম ফাটিয়ে দেয়। কিন্তু যে করতে পারে না, তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয় উলটো।

‘প্রিয়তমা’র ক্ষেত্রে সেই উলটো জিনিসটাই ঘটেছে। পরিচালক একটা পিওর রোমান্টিক গল্পের ভেতর হিরো-ভিলেনের রেষারেষিকে বেশি জায়গা দিয়েছেন। ভিলেন হিসেবে শহীদুজ্জামান সেলিম তুখোড়, তার প্রতিপক্ষ হিসেবে লুৎফর রহমান জর্জও কম যান না! কিন্তু এই সাবপ্লটে বেশি ফোকাস করতে গিয়ে সিনেমার গল্প খেই হারিয়েছে। সিনেমায় ফাইট সিন রাখা হয়েছে, কিন্তু ডিজাইন ভালো হয়নি। কমেডি সিন রাখা হয়েছে, কিন্তু কমেডির লেখা ভালো হয়নি। সবমিলিয়ে পরিচালক হিমেল আশরাফ শাকিব খানের ভক্তদের জন্য যেসব উপাদান সিনেমাতে রাখতে চেয়েছেন, সেগুলো তিনি ভালোভাবে দেখাতেই পারেননি। উল্টো ‘প্রিয়তমা’র মূল গল্পটি, এ সিনেমার মূল ইমোশনের জায়গাটি.. সিনেমাতে আসে অনেক পরে, বলা যায় সিনেমার শেষ তৃতীয়াংশে।

‘প্রিয়তমা’র গল্পটা দিয়ে দর্শকের হৃদয় ছোঁয়ার একটা চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে এ সিনেমায় হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো বিশেষ মুহূর্তের অভাব আছে। শাকিব খান ও ইধিকা পালের চরিত্রের ভেতর একটা পাগলামির অভাব আছে। যেই পাগলামি আমরা দেখতে পাই হিন্দি ‘কবির সিং’-এ শহীদ কাপুরের মধ্যে। বাংলা চলচ্চিত্রের উদাহরণ টানলে বলা যায় ‘পরাণ’-এর কথা, যে পাগলামি আমরা দেখতে পাই শরীফুল রাজের মধ্যে। এই পাগলামির দরকার ছিল ‘প্রিয়তমা’তে। কিছু স্পেশাল মোমেন্টের দরকার ছিল, যেগুলো একবার দেখলে বারবার দেখার ইচ্ছা জাগবে।

অভিরুচির সাউন্ড কোয়ালিটি ভালো, কিন্তু পর্দার খুব বাজে অবস্থা, ঘোলা। সেজন্যে কারিগরি দিক নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কিছু বলতে পারছি না। তবে খালি চোখে দেখে কিছু ব্যাপার মনে হয়েছে। যেমন ক্যামেরার কাজ ভালোই হয়েছে। কক্সবাজারকে গল্পে সংযুক্ত করতে পারায় এই সিনেমার সৌন্দর্য বেড়েছে, শ্যুট করতে সুবিধাও হয়েছে। তবে এডিটিংয়ে প্রচুর ভুল-ভ্রান্তি আছে। তাড়াহুড়োর কাজ, তাই এই অবস্থা। পোস্ট প্রডাকশনে আরো প্রায় এক মাস বেশি সময়ের প্রয়োজন ছিল। এতে করে আমাদের ডাবিং সমস্যা দেখতে হতো না। সিনেমার সাউন্ড প্রবলেম দেখতে হতো না। ফাইট সিকোয়েন্সে অনেক জায়গায় হাস্যকরভাবে চিটশট ইউজ করা হয়েছে, সেগুলোও দেখতে হতো না।

‘প্রিয়তমা’ চলচ্চিত্রে আরেকটি প্রত্যাশার জায়গা ছিল এর মিউজিক। বালাম, প্রিন্স মাহমুদের মতো প্রতিষ্ঠিত নাম যে চলচ্চিত্রের সাথে সংযুক্ত, প্রত্যাশা রাখাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যি কথা বলতে এই জায়গায় আমি কেবল একটি গান ভালো পেয়েছি। সোমেশ্বর অলির লেখা ও প্রিন্স মাহমুদের সুরে রিয়াদের ‘ঈশ্বর’ গানটা গল্পের সঙ্গে যাচ্ছিল, শুনতেও ভালো লাগছিল। বাকি গানগুলো বেকার ছবির দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছে। এর মধ্যে আমাদের ওপার বাংলার শ্রদ্ধেয় আকাশ সেনের ভালো অবদান রয়েছে। তার সুর করা দুটি গানের একটাও অথেনটিক কোনো ফিল দেয় না। রেডিমেড মিউজিশিয়ানের রেডিমেড গান!

আমি মনে করি, হিমেল আশরাফ যদি শ্রদ্ধেয় ফারুক হোসেনের লেখা গল্পের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতেন, গল্প অনুসারে যদি একটি পরিপূর্ণ রোমান্টিক সিনেমা বানাতেন, তাহলে ‘প্রিয়তমা’ আরো ভালো একটা চলচ্চিত্র হতে পারতো। বর্তমানে আমরা যে যুগে আছি সেখানে বলা হয়ে থাকে ‘কনটেন্ট ইজ দ্য কিং’। আপনার কনটেন্ট ভালো হলে এমনিতেই ভালো চলবে, সেজন্যে আপনার বিশেষ শ্রেণীর দর্শককে টার্গেট করার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র আস্থা রাখতে হবে, নিজের গল্পের প্রতি সৎ থাকতে হবে।

রেটিং: ৫/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্লগার ও ইউটিউবার

মন্তব্য করুন