Select Page

সালমান শাহ: যদি গঠিত হও, তবে কেন শূন্যে মিলাও!

সালমান শাহ: যদি গঠিত হও, তবে কেন শূন্যে মিলাও!

হে প্রিয় নায়ক,
যদি গঠিত হও
তবে কেন শূন্যে মিলাও!

তোমার জন্য যে দেশের চলচ্চিত্র আধুনিকতার স্পর্শে ধন্য হলো, তাকে রেখে কেন তুমি চলে যাও!

তুমি দেখিয়েছ ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এ সরল, গভীর এক প্রেমিককে যার স্বপ্নই ছিল প্রেয়সীর জন্য নিজেকে উজাড় করে দেয়া। কণ্ঠে ছিল গান-‘তোমার জন্য গড়েছি আমি মঞ্জিল ভালোবাসার’। তারপর থেকে প্রেমিকরা যার যার অন্তরে তাদের প্রেয়সীর জন্য ভালোবাসার মঞ্জিল গড়ল।

তুমি দেখিয়েছ ভালোবাসার জন্য ঘর ছেড়ে নিজেকে প্রমাণ কি করে করতে হয়। ‘তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই/আর কিছু জীবনে পাই বা না পাই’ এ গানের সাথে একাত্ম হয়ে সেই ‘তুমি’-কে জয়ের জন্য ঘর ছেড়ে কাজ করে নিজেকে প্রমাণ করে মর্যাদার সাথে প্রেয়সীর কাছে বিশেষ কেউ হয়ে উঠেছ। এ সমাজে আজও যুগলরা পরস্পরকে ভালোবাসে তখন তাদের মুখেও পরস্পরের জন্য একটাই কথা থাকে ‘তোমাকে চাই’।

তুমি দেখিয়েছ ‘পুরুষ বড় হয় জগতে নারীর কারণে’। বেকার ছেলে যখন বিয়ে করে আর সহধর্মিণী পৌরুষকে আঘাত করে কথা বলে তখন পুরুষ কীভাবে দপ করে নিভে যাবার আগে আবার পূর্ণশক্তিতে জ্বলে উঠতে পারে তুমিই দেখিয়েছ। তারপর নিজের জীবনের প্রথম আয় দিয়ে অভুক্ত থাকা জেদী সহধর্মিণীর জন্য খাবার নিয়ে এলে যখন সে তৃপ্তি সহকারে খায় তখন তুমিই সর্বাগ্রে জয়ী হও। আজও সমাজে শত শত নারীর জন্য শত শত পুরুষ বড় হয় আর তখন তুমিই জয়ী হয় সেই উদাহরণ পর্দায় দেখানোর জন্য।

তুমি দেখিয়েছ ভালোবেসে সমাজ-সংসারের ভয়ঙ্কর রূপ যখন ছিঁড়ে খেতে চায় ক্ষমতা, ক্রোধের মাধ্যমে তখন একজন প্রেমিক সেই শিকারে পরিণত হয় ‘আনন্দ অশ্রু’-তে। প্রেমে যে আনন্দ শুরুতে তুমি পাও, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষে গীতিকার তুমি একটা কবিতা লেখো-‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা/হৃদয়ে সুখের দোলা’। সেই সুখের দোলা ক্ষণস্থায়ী হয়ে শুধু রোমাঞ্চই আনে কিন্তু অশুভ শক্তি গ্রাস করে তোমাকে। তারপর সবকিছু হারিয়ে মাথাভর্তি এলোমেলো চুলে, দেয়ালে একা একা যা ইচ্ছে এঁকে, অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গিতে তোমার ঠিকানা হয় মানসিক হাসপাতাল এবং একসময় সেই অশুভ শক্তির হাতেই শেষ হতে হয় তবে তা দৈহিকভাবেই কেননা আত্মিকভাবে সেই তুমি প্রেমের যে শক্তি দেখিয়ে যাও তার মৃত্যু নেই। আজও সমাজের জুটিগুলো অশুভ শক্তির হাতে পড়ে এবং তারাও দৈহিকভাবে অনেকে চলে যায় মহাকালের নিয়মে কিন্তু তাদের প্রেম থেকে যায়।

তুমি দেখিয়েছ ভালোবাসার মানুষটিকে না পাবার যন্ত্রণায় বাঁচার থেকে মৃত্যুই শ্রেয়। ধর্ম, অনুশাসন, পরিবার, সমাজ সবকিছুকে সম্মান করে যখন ভালোবাসাকে বিসর্জন দেয়া হয় তখন নিজের জন্য মৃত্যুটাই যেন সত্য হয়ে ওঠে কেননা জীবন্ত লাশ হয়ে বাঁচার থেকে মৃত্যুটাই যেন ভালো মনে হয় তখন। তাই ‘প্রেম পিয়াসী’ তুমি সটান ঝুলে পড়ো সিলিং ফ্যানে আর ডুকরে কাঁদতে থাকে মা। ছবির এই চরিত্র এবং মৃত্যু কাম্য না কারোরই কিন্তু যার জন্য পৃথিবীটা মরুভূমির মতো হয়ে গেছে তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে কে আটকাবে!

তুমি দেখিয়েছ ‘একাত্তরের মা জননী’-কে প্রশ্ন করতে ‘কোথায় মুক্তিসেনার দল’ যারা আজকের সমাজের সমস্ত অশুভ গুলোকে সমূলে বিনাশ করে শুভর চেতনা জাগাতে পারে। তুমি দেখিয়েছ ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়/এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়’ বলতে। সভ্যতার আজকের অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, ক্ষমতার আধিপত্য প্রতিদিনের গল্প। এগুলোর বিরুদ্ধে ‘বিক্ষোভ’ তাই জরুরি হয়ে ওঠে।

তুমি দেখিয়েছ মা কীভাবে জীবনে শ্রেষ্ঠতম সম্পদ হয়ে ওঠে। যে ‘মায়ের অধিকার’ হারিয়ে যায় তাঁর সে হারানো অধিকারকে ফিরিয়ে আনার জন্য সন্তান কত সুগভীর পরিকল্পনা করতে পারে। সবার চোখে যা অন্যায় মনে হয়, মায়ের চোখে যা সন্তান কষ্ট দিয়ে চলে যাওয়ার মতো মনে হয় তার গভীরেই তুমি তোমার ভেতরের কথাটিকে বাইরে এনে দাও অত্যন্ত সুকৌশলে। যা বোঝার জন্য সেই মাহেন্দ্রক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় যেখানে অহংকারের পতন ঘটিয়ে মায়ের অধিকার আদায়ের বাণীটি আসে-‘দাঁড়াও, ওখানেই দাঁড়াও। সামনের সিঁড়িগুলো পার হয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করো না।’ যে জাহান মঞ্জিলের সিঁড়িতে মা উঠতে পারেনি সেই সিঁড়িতে সহধর্মিণীও উঠতে পারবে না এবং সেই সিঁড়ি হয়ে ওঠে মায়ের অধিকার আদায়ের প্রতীক।

তুমি দেখিয়েছ মায়ের সম্মান যেন বিচারালয়েও ঠিক থাকে, মায়ের সাক্ষ্য যেন তার জন্য মিথ্যা না হয় তাই সত্যকে গোপন করে হলেও চুপ থাকাই শ্রেয় ভেবেছ। কিন্তু ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ তাই সে সত্য অন্তিম মুহূর্তে তুমিই জানিয়ে দাও মাকে আর মা ফের পূর্ণশক্তিতে জানিয়ে দেয় যে সত্যের জন্য নিজের সন্তানকে কোরবানি দিতে চেয়েছে তা এত বড় মিথ্যে হতে পারে না এবং মিথ্যার শক্তিকে পরাজিত করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে সন্তানকে বাঁচায়। তুমিই সেই সন্তান সেলুলয়েডে।

সেই তুমি এত এত অনুপ্রেরণা রেখে কেন চলে যাও বাস্তবে! কেন নিঃস্ব করে যাও চলচ্চিত্রকে!
যদি গঠিত হও
তবে কেন শূন্যে মিলাও!
কবিও হয়তো জানতেন না, তুমি কি জানো!

শুরুর ছবি – আনন্দ বিচিত্রা (১৯৯৫)


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন